উত্তর-দক্ষিণ দিক চেনার সহজ উপায় কী

ছবি: সংগৃহীত

আপনি নতুন কোনো জায়গায় গিয়েছেন। কোনটা উত্তর, কোনটা দক্ষিণ বুঝতে পারছেন না। কী করবেন? অবশ্য এখন তো অনেকের কাছেই স্মার্টফোন বা স্মার্ট হাতঘড়ি আছে। সেখানে কম্পাস দেখে চট করে দিক চিনে নিতে পারবেন। যদি সে ব্যবস্থা না থাকে? দিনের বেলা আকাশে সূর্যের অবস্থান থেকে কিছুটা অনুমান করতে পারবেন; যদিও সেটাও তেমন সহজ নয়। একটা নিয়ম জানতে হবে। সে বিষয়ে বলছি। কিন্তু যদি রাতের বেলা হয়, তাহলে দিক চিনবেন কীভাবে? সেটা জানারও একটা কৌশল আছে।

দিনের বেলা দক্ষিণ দিক চেনার কৌশল

সাধারণ একটা হাতঘড়ি থাকতে হবে আর আকাশে থাকতে হবে সূর্য। প্রথমে হাতঘড়িটি মাটির সমান্তরালে রেখে এর ঘণ্টার কাঁটা সূর্যের দিকে রাখি। এখন ঘণ্টার কাঁটা ও ঘড়ির ১২ চিহ্নিত ঘরের মধ্যবর্তী কোণের সমদ্বিখণ্ডক রেখা বরাবর দিকটিই হবে দক্ষিণ। দুপুর ১২টার আগে হলে দক্ষিণ দিকটি হবে ঘড়ির ১২ চিহ্নিত ঘরের বাঁ পাশে আর দুপুর ১২টার পর হবে ডান পাশে। ঠিক দুপুর ১২টায় ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটা ১২ চিহ্নিত ঘর বরাবর থাকবে বলে ওই দিকই হবে দক্ষিণ। আমাদের দেশ উত্তর গোলার্ধে। তাই এ কৌশল কেবল উত্তর গোলার্ধের দেশেই প্রযোজ্য। যদি দক্ষিণ গোলার্ধের কোনো দেশ, যেমন অস্ট্রেলিয়া, থেকে দিক নির্ধারণ করতে চাই, তাহলে ঘড়ির ১২ চিহ্নিত ঘরটি সূর্য বরাবর রেখে ঘণ্টার কাঁটার সঙ্গে সৃষ্ট কোণের দ্বিখণ্ডক রেখা বরাবর দিকটি উত্তর দিক নির্দেশ করবে।

কোণের দ্বিখণ্ডক রেখা কেন

এ প্রশ্ন মনে দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। এর ব্যাখ্যা হলো, ঠিক দুপুর ১২টা থেকে পরদিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা সময়ে পৃথিবী তার অক্ষরেখার চারপাশে একবার ঘুরে আসে। কিন্তু এ সময়ে ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটা ঘড়ির ডায়ালের চারপাশে দুবার ঘুরে আসে। তাই ঘড়ির কাঁটা ও সূর্যের অবস্থানের মধ্যবর্তী কোণের সমদ্বিখণ্ডক রেখা দক্ষিণ দিক নির্দেশ করে।

রাতের বেলা কীভাবে দিক চিহ্নিত করব

প্রাচীনকালে মানুষ নৌকায় সমুদ্রযাত্রা করার সময় রাতের বেলা আকাশের তারা দেখেই দিক চিহ্নিত করত। কিন্তু পৃথিবী নিজ অক্ষরেখার চারপাশে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অবিরাম ঘুরছে, তাই আকাশে তারার অবস্থান স্থির থাকে না। আজ রাতে একটি নির্দিষ্ট তারা আকাশের যেখানে থাকে, কাল রাতে একটু এদিক-ওদিক সরে যায়। এ অবস্থায় বিজ্ঞানীরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করে আবিষ্কার করেন, অন্য সব তারা আকাশে অবস্থান বদলালেও উত্তর আকাশে একটি উজ্জ্বল তারা প্রতি রাতে একই অবস্থানে থাকে। নড়েচড়ে না। এ তারাই হলো ধ্রুবতারা। ইংরেজিতে পোলারিস, পোলস্টার বা নর্থপোল স্টার নামে পরিচিত। নাবিকেরা রাতের আকাশ দেখে সহজেই ধ্রুবতারাটি বের করে ফেলে এবং তখন বুঝতে পারে ওই দিকই উত্তর। সুবিধা হলো, এই তারা খুব উজ্জ্বল এবং মেঘমুক্ত আকাশে খালি চোখে স্পষ্ট দেখা যায়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নিরাপদ সমুদ্রযাত্রা সম্ভব হলো। এখানে বলা দরকার, মাঝসমুদ্রে ভাসমান জাহাজ থেকে দিক নির্ধারণ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দিক চেনায় ভুল হলে মহাবিপদে পড়ার আশঙ্কা থাকে। যেমন পর্তুগাল থেকে ভারতে যাওয়ার জন্য নাবিকেরা রওনা দিলেন। দিক ভুল করে পৌঁছে গেলেন দক্ষিণ আমেরিকায়। একেবারে উল্টো দিকে। আবার অনেক সময় দিক ভুলের জন্য সমুদ্রের বিপজ্জনক অঞ্চলে গিয়ে পড়ার ভয়ও থাকে। তাই আদি যুগে সমুদ্রপথে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে রাতের আকাশে ধ্রুবতারা দেখে পথ চেনার কৌশল বিশাল অবদান রেখেছে।

ধ্রুবতারা কেন স্থির অবস্থানে থাকে

এর উত্তর জানাটা খুব দরকার। আকাশে সব তারা অনবরত স্থান বদলায়, তাহলে ধ্রুবতারা কেন স্থির? এর কারণ হলো আকাশে ধ্রুবতারার বিশেষ অবস্থান। পৃথিবী যে কল্পিত অক্ষরেখার চারপাশে আবর্তিত হচ্ছে, সেই রেখাকে উত্তর আকাশ বরাবর মহাশূন্যে বিস্তৃত করলে দেখা যাবে ধ্রুবতারাটি সেই রেখার খুব কাছ ঘেঁষে অবস্থান করে। ফলে পৃথিবী নিজ অক্ষরেখার চারপাশে আবর্তন করলেও ধ্রুবতারা আকাশে প্রায় একই স্থানে অবস্থান করে। এ না হলে হয়তো ঘড়ি বা কম্পাস আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত সমুদ্রযাত্রায় সমস্যা হতো। ব্যবসা-বাণিজ্য ধীরে চলত। হয়তো সভ্যতার অগ্রগতিও বাধাগ্রস্ত হতো।

ধ্রুবতারার অবস্থান কি একদম স্থির

সঠিকভাবে বললে বলতে হয় প্রায় স্থির। কারণ, ধ্রুবতারাটি পৃথিবীর বর্ধিত অক্ষরেখার ওপর নয়, প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করে। ওদিকে পৃথিবীর আবর্তন অনেকটা লাটিমের মতো। একটু এদিক-ওদিক হেলে, সামান্য চক্কর কেটে ঘোরে। ফলে একসময় হয়তো উত্তর আকাশে ধ্রুবতারা দেখা যাবে না। মহাকাশবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ধ্রুবতারা উধাও হতে এখনো অনেক সময় লাগবে। একবার উধাও হলেও অবশ্য সেটা চিরকালের জন্য নয়। মহাকাশবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ২৫ থেকে ৩০ হাজার বছর পর উত্তর আকাশে সেই একই ধ্রুবতারা আবার দৃশ্যমান হবে। মাঝখানের সময়টুকুতে একটু কম উজ্জ্বল কোনো তারা ধ্রুবতারার মতো অবস্থান গ্রহণ করতেও পারে।

দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে কি ধ্রুবতারা দেখা যায়

যেহেতু ধ্রুবতারা উত্তর মেরু বরাবর আকাশে অবস্থান করে, তাই এটা দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে দেখা যায় না। একদম উত্তর মেরু থেকে ধ্রুবতারা দেখা যাবে প্রায় মাথার ওপর। এরপর ক্রমে দক্ষিণ দিকে যেতে থাকলে ধ্রুবতারাকে আকাশে দিগন্তরেখার দিকে নামতে দেখা যাবে। দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে ধ্রুবতারা দেখা যাবে না।

দক্ষিণ মেরুর আকাশে কি ধ্রুবতারা ধরনের অন্য কিছু আছে

না, সেটা নেই। দক্ষিণ মেরু বরাবর ঊর্ধ্বাকাশে উজ্জ্বল কোনো তারা নেই। তাই দক্ষিণ মেরুতে কোনো ধ্রুবতারা ধরনের কিছু নেই। থাকলে অবশ্য ভালোই হতো। পৃথিবীর সব এলাকা থেকেই রাতের আকাশ দেখে উত্তর-দক্ষিণ দিক নির্ধারণ সম্ভব হতো।

আব্দুল কাইয়ুম, বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক ও প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক। [email protected]