কত দেশের উপকূল ডুবে যেতে পারে

কুতুবদিয়া দ্বীপে নিজ ঘরের পাশে সন্তানসহ দাঁড়িয়ে আছেন হামিদা বেগম। জোয়ারের সময় এ ঘর ডুবে গেলে অন্যত্র চলে যেতে হয় হামিদাকে। দ্বীপ উপজেলাটিতে এখনো প্রায় এক লাখ লোক বাস করে। বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংস্থা সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে পুরো দ্বীপটিই পানির নিচে তলিয়ে যাবে। ছবিটি গত বছরের ২০ নভেম্বর তোলাএএফপি

যে হারে বায়ুমণ্ডলে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন গ্যাস বা সহজ ভাষায় কার্বন নিঃসরণ ঘটছে, এর ফলে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হয়তো ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ডুবতে থাকবে। চট করে চোখে পড়বে না। কিন্তু ধরা যাক ১০০ বছর পরের চিত্রটি কী রকম হতে পারে? সেটা হিসাব করলেই বুঝতে পারব আমরা কত বড় বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। বিশ্বের জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা এখন হিসাব করে দেখছেন, কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়। একসময় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বলত, ও, বাংলাদেশ, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আর বন্যা-বৃষ্টির দেশ! আর আজ দেখি ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু করে অনেক উন্নত দেশের বড় বড় শহর আকস্মিক ঝড়-বৃষ্টি বন্যায় ভেসে যায়। এ সবই জলবায়ু পরিবর্তনের আলামত।

হিমালয়ের এভারেস্টসহ বিশ্বের উঁচু পর্বতমালার চূড়ায় জমে থাকা বরফ ও তুষার, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বা আর্কটিক ও অ্যান্টার্কটিকার জমাট বাঁধা বরফ এখন গলতে শুরু করেছে। আমরা কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব সাদাচোখে দেখি না, কিন্তু ঘটনা ঘটে চলেছে।

কত হারে বাড়ছে সমুদ্রের পানির উচ্চতা

লাইভ সায়েন্সের অনলাইন সংস্করণে সম্প্রতি জো ফেলানের একটি তাৎপর্যপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লন্ডনভিত্তিক সাংবাদিক। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকস ম্যাগাজিনেও লেখেন। তিনি বলেন, সমুদ্রতলের উচ্চতা খুব দ্রুত বাড়ছে। উচ্চতা বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমসফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) এক হিসাব অনুযায়ী, গত শতাব্দীতে বেড়েছে প্রতিবছর গড়ে ০.০৬ ইঞ্চি। আর এখন প্রতিবছর গড় বৃদ্ধির হার ০.১৪ ইঞ্চি।
এই সংস্থার অনুমান, আগামী শতাব্দীর শুরুতে পানির উচ্চতা দুই হাজার সালে যা ছিল, তার চেয়ে হয়তো এক ফুট বাড়বে। অন্যদিকে ইউনাইটেড নেশনস ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের এক হিসাব অনুযায়ী, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ১৬ থেকে ২৫ ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়তে পারে।

কত মানুষ বিপন্ন হবে

মনে হয় সমুদ্রের পানির উচ্চতা মাত্র এক বা দেড় ফুট বাড়লে এমন আর কী সমস্যা হবে। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বুঝব, আমাদের দেশের উকূলে এখনই কী সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ইতিমধ্যে শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্য অনেক দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বনভূমি ও আবাসস্থল পানির নিচে চলে যাচ্ছে। দেশের ভেতরেই সৃষ্টি হচ্ছে স্থানীয় উদ্বাস্তু।

নেচার কমিউনিকেশনসের ২০১৯ সালের এক গবেষণায় জানা গেছে, ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব মহাদেশ মিলিয়ে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই বিশাল সমস্যার চাপ পড়বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

কত দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে

আমরা হয়তো ভুলে যাইনি, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের আগমুহূর্তে ২০০৯ সালের ১৭ অক্টোবর বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ সমুদ্রের পানির নিচে টেবিল-চেয়ার নিয়ে মন্ত্রিপরিষদের সভা করেছিলেন। সেটা ছিল বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের বিরুদ্ধে এক অভিনব প্রতিবাদ। মালদ্বীপ হলো ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপপুঞ্জ। এটা সমুদ্রের পানির চেয়ে ৭ ফুট উচ্চতায়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে মালদ্বীপের মতো আরও অনেক দেশের উপকূলীয় অঞ্চল সাগরে তলিয়ে যেতে পারে। তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নীতি নির্ধারকদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য মন্ত্রীরা স্কুবা-গিয়ার পরে সাগরের পানির নিচে মন্ত্রিপরিষদের সভা করেন। সে সময় এ ঘটনা সবার মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ওই সময় প্রেসিডেন্ট নাশিদ বলেছিলেন, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ সমুদ্রের মাত্র ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে বাস করে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে তাদের অনেকের জীবনযাত্রা বিপন্ন হবে।

এই শতাব্দীর শেষ দিকে আমেরিকা, ইউরোপ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর এক বিরাট অংশের উপকূল সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট ঝুঁকিতে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তার মানে, বিশ্ব এখন এক অগ্নিপরীক্ষার মুখে। আমরা কী পারব বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে আনতে?

উপায় কী

আমাদের সচেতন উদ্যোগ অবশ্যই দরকার। জ্ঞান–বিজ্ঞানের যে সুউচ্চ অবস্থানে বিশ্ব পৌঁছেছে, সেখান থেকে নিশ্চয়ই সবার মিলিত উদ্যোগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমরা নিতে পারব। একদিকে কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যদিকে আধুনিক প্রকৌশল বিদ্যা কাজে লাগিয়ে বাঁধ নির্মাণ করে সমুদ্রের পানি আটকাতে হবে। নেদারল্যান্ডস সমুদ্রের পানির উচ্চতার নিচে। সেখানে শক্ত বাঁধ নির্মাণ করে আধুনিক নগর গড়ে তোলা হয়েছে। এ রকম একটা কিছু হয়তো কোনো কোনো দেশে করা সম্ভব হবে। কিন্তু এর জন্য যে বিশাল বাজেট দরকার, সেটা কতটা দেশ সামাল দিতে পারবে?

লেখক: আব্দুল কাইয়ুম, বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক ও প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক, [email protected]