কৃষি ও কৃষকের জন্য প্রযুক্তিসেবা দিচ্ছে এই উদ্যোগ

আইফার্মার গবাদিপশুর খামারে প্রযুক্তি ও তথ্যসেবা দিয়ে থাকেছবি: সংগৃহীত

সবকিছুতেই এখন তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ছোঁয়া। কৃষি খাতও আধুনিকের বাইরে নেই। বাংলাদেশে কৃষি খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে কাজ করছে অনেক উদ্ভাবনী উদ্যোগ বা স্টার্টআপ। এমনই একটি স্টার্টআপ আইফার্মার লিমিটেড। আইফার্মার কৃষকদের আর্থিক পরামর্শ, আবহাওয়ার হালনাগাদ, আধুনিক প্রযুক্তি, শস্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নানাভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা করে থাকে। আইফার্মারের প্রতিষ্ঠাতা ফাহাদ ইফাজ ও জামিল এম আকবর। আইফার্মারের নিবন্ধিত কৃষকদের প্রত্যেকের ৬০ ধরনের তথ্য–উপাত্ত প্রতিষ্ঠানটির তথ্যভান্ডারে।

কৃষকের গবাদিপশু পালন ও শস্য উৎপাদনে প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি কৃষিপণ্য বিক্রির সুযোগ দিচ্ছে আইফার্মার। পাবনার নাজিরপুরে গত রোববার গিয়ে তা দেখাও গেল। আইফার্মার সেন্টারে কথা হয় পাবনার খামারি মাহাবুবুল আলমের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৯৯৯ সাল থেকে গবাদিপশু বিপণনের সঙ্গে যুক্ত। তখন তিনি স্থানীয়ভাবে গরু সংগ্রহ করে রাজধানী ঢাকার বড় বড় প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করতেন। পরবর্তী সময়ে ২০০২ সালে নিজেই খামার প্রতিষ্ঠা করেন। প্রচলিত ব্যবস্থায় গবাদিপশু উৎপাদন ও লালন–পালন করে চলছিলেন এই খামারি। ২০১৯ সালে আইফার্মারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রযুক্তিনির্ভর খামার ব্যবস্থাপনার বিপণনে যুক্ত হন। বর্তমানে মাহাবুবুলের খামারে চারজন কাজ করেন, আরও ১৫০ কৃষক ও খামারি তাঁর সঙ্গে কাজ করছেন। মাহাবুবুলের স্ত্রী আনজুমনোয়ারা খাতুন খামারের দেখভাল করেন। মুঠোফোনের মাধ্যমেই পশুপালনের নানা কিছু শিখেছেন। তাঁদের দুই মেয়ে, বড় মেয়ে লাবিবা এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন আর ছোট মেয়ে অমিয়া অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। লাবিবার নামেই নামকরণ করেছেন লাবিবা ডেইরি ফার্ম।

মুঠোফোন অ্যাপের মাধ্যমে চলে পশু ও কৃষিপণ্যের বিপণন
ছবি: সংগৃহীত

পাবনার নাজিরপুরের পশ্চিমপাড়ায় মাহাবুবুলের খামার। তিনি বলেন, ‘আগে সাধারণভাবে ব্যবসা করতাম। গরু পালনের চ্যালেঞ্জ অনেক। সারা বছরই গরুর চাহিদা থাকে। কোরবানির ঈদ ছাড়াও নানা উৎসব–আয়োজনে গরুর চাহিদা থাকে। আমরা কৃষক ও খামারি সেই চাহিদা পূরণে কাজ করছি। আমাদের জাতীয় যে চাহিদা, সেখানে ঘাটতি আছে। আমি এখন আইফার্মারের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার শিখেছি। যে কারণে ঋণব্যবস্থা থেকে শুরু করে পশুপালনের নানা বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছি। আমাদের এলাকায় অনেক তরুণও এখন প্রযুক্তিনির্ভর খামারে কাজ করছেন।’

এক থেকে যেন অসংখ্য মাহাবুবুল

নাজিরপুরের আইফার্মার সেন্টারে এসেছেন তরুণ মহিউল বারী। তিনি বলেন, ‘একটা সময় কৃষিকাজ বা খামারে আগ্রহ ছিল না, কিন্তু এখন আইফার্মারের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কারিগরি সুবিধা পাচ্ছি। শহরে না গিয়ে আমরা গ্রামে থেকে এখন খামারের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। এখন সব কৃষক ও খামারির হাতেই স্মার্টফোন রয়েছে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে ফসল, সবজি ও পশু বিক্রির সুযোগ আছে অনেক।’ এইচএসসি পাস করেই মহিউল বারী প্রযুক্তিনির্ভর খামারে কাজ শুরু করেন। এখন আইফার্মারে কর্মী হিসেবে কাজ করছেন।

পাবনায় পাঁচটি আইফার্মার সেন্টারের মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। হেমায়েতপুর, মালিগাছা, দাপুনিয়া, ঈশ্বরদীর মতো এলাকায় অসংখ্য কৃষকের আর্থিক সুবিধা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে খামার ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করছে আইফার্মার। শুধু গবাদিপশু নয়, বিভিন্ন ধরনের ফসল ও সবজি চাষ করতে সহায়তা করে আইফার্মার। পাবনার নাজিরপুরে কাওসার আহমেদ, রবিউল ইসলাম, মুহম্মদ তারেক, আরিফা খাতুনসহ অসংখ্য তরুণের দেখা মেলে, যাঁরা প্রযুক্তির মাধ্যমে খামার ব্যবস্থাপনা শিখে কাজ করছেন।

পাবনায় বিভিন্ন খামারের পশুপালন ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে আইফার্মার
ছবি: প্রথম আলো

প্রযুক্তির মাধ্যমে ফসল বিপণন

‘সফল’ নামের একটি অ্যাপের মাধ্যমে আইফার্মারের সেবা নিচ্ছেন কৃষক ও খামারিরা। এই অ্যাপের মাধ্যমে মাঠকর্মী ও খুচরা বিক্রেতারা কৃষকদের সহজে সেবা দিচ্ছেন। কৃষকেরা সেখানে ই-কেওয়াইসির মাধ্যমে নিজেদের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করে নিতে পারেন। প্রয়োজনীয় তথ্য সফল অ্যাপে পাওয়া যায়। আইফার্মার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের নিয়ে কাজ করার জন্য খরচ ও জটিলতা কমাতে মোবাইল প্রযুক্তি ও ‘রিমোট সেন্সিং’প্রযুক্তি ব্যবহার করে। কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক আবহাওয়ার হালনাগাদ তথ্য মিলছে এই অ্যাপের মাধ্যমে। ইন্টেলিজেন্ট সয়েল সেন্সর দিয়ে দ্রুত ও সাশ্রয়ী উপায়ে মাটির উর্বরতা, পিএইচ ও আর্দ্রতা নিরীক্ষণ ও বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করে আইফার্মার। দুগ্ধজাত গবাদিপশুর জন্য ফিটবিট হিসেবে পরিচিত কাউডি ব্যবহার করে আইফার্মার। এই স্মার্টযন্ত্র গরুসহ অন্য গবাদিপশুর স্বাস্থ্য, গতিবিধি ও প্রজননচক্র সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করে এবং খামারমালিকদের সময়মতো তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে।

প্রযুক্তি দূর করেছে বিড়ম্বনা

প্রযুক্তিনির্ভর নানা ধরনের সেবার মাধ্যমে আইফার্মার কৃষকদের মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের হাত থেকে রক্ষা করছে। খামারি আনজুমনোয়ারা খাতুন বলেন, এখন সরাসরি অ্যাপের মাধ্যমেই পশু কেনাবেচার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সামনে ঈদুল আজহা। এ সময় কোরবানির পশু কেনার জন্য ক্রেতারা আইফার্মারের সফল–এর মতো অ্যাপ ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে দ্রুত কোরবানির পশু খামার থেকে ক্রেতার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, এখন রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন মাংস বিক্রেতার কাছে খামারিরা অ্যাপের মাধ্যমে পৌঁছে দিচ্ছেন গবাদিপশু।

পাবনার নাজিরপুরে আইফার্মার সেন্টারে পরামর্শ নিতে আসেন স্থানীয় কৃষকেরা
ছবি: প্রথম আলো

আইফার্মারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফরহাদ জুলফিকর জানান, ‘আমরা কৃষক ও খামারিদের সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ করে দিচ্ছি। কৃষকেরা আইফার্মারের সয়েল সেন্সর প্রযুক্তির মাধ্যমে মাটির প্রাথমিক তথ্য গ্রহণ করছেন। এ ছাড়া কৃষকেরা স্যাটেলাইটভিত্তিক রিমোট সেন্সিংয়ের ওপর ভিত্তি করে পরামর্শ পান এবং নিয়মিত আবহাওয়ার পূর্বাভাস পান। আইফার্মার ন্যায্যমূল্যে ২৪ ঘণ্টায় অর্থ প্রদান ও ঝামেলামুক্ত সেবা দিয়ে থাকে।

ক্রেতার বিশ্বাসে প্রযুক্তির বহুমাত্রিক ব্যবহার

২০২৩ সালে আইফার্মার প্রায় সাড়ে তিন হাজার খামারিকে সহায়তা করেছে। ২০২৩ সালে প্রায় ২৮ হাজার ২০০ কৃষক আইফার্মারের কাছ থেকে এসএমএসের মাধ্যমে আবহাওয়া ও অন্যান্য তথ্য পেয়েছেন। ফরহাদ জুলফিকর জানান, ‘আমাদের নিবন্ধিত কৃষকের সংখ্যা ১ লাখ ১২ হাজারের বেশি। আমরা কৃষকদের জন্য ২৪২ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছি। আমাদের অ্যাপের মাধ্যমে ২৮৭ হাজার টন ফসল বিক্রি করেছেন কৃষকেরা। কৃষকদের কেন্দ্র করে আইফার্মার বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। কৃষকেরা তাঁদের খামার পরিচালনা এবং কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি কেনার জন্য কম খরচে, জামানতমুক্ত অর্থায়নের সুযোগ পাচ্ছেন আইফার্মারের অ্যাপ ও সেন্টারের মাধ্যমে।’