অনলাইন খাবার ও গ্রোসারি সরবরাহের অ্যাপ ফুডপ্যান্ডা বাংলাদেশের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আম্বারীন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে সহপ্রতিষ্ঠাতা জুবায়েদ সিদ্দিকীর সঙ্গে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। ২০১৬ সালে বার্লিনভিত্তিক ‘ডেলিভারি হিরো’ নামের প্রতিষ্ঠান তা অধিগ্রহণ করে। আম্বারীন রেজা অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইন্যান্সে পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কৃতী শিক্ষার্থী হিসেবে ডিনস অ্যাওয়ার্ডও লাভ করেন। আইসিএ অস্ট্রেলিয়া থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের সনদ আছে তাঁর। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ফেরার আগে অস্ট্রেলিয়ায় আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াং নামের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। সম্প্রতি দশম ব্র্যাক ব্যাংক-ডেইলি স্টার আইসিটি অ্যাওয়ার্ডসে ‘উইমেন অব দ্য ইয়ার’ সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি আপনি ব্র্যাক ব্যাংক-দ্য ডেইলি স্টার আইসিটি অ্যাওয়ার্ডসে ‘উইমেন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়েছেন। দীর্ঘ ১২ বছরের এই যাত্রার পর এমন একটি সম্মাননা আপনার কাছে কতটা অনুপ্রেরণাদায়ক?
আম্বারীন রেজা: দেখুন, ছোটবেলায় যখন স্কুল-কলেজে পড়তাম, তখন থেকেই আমি নিয়মিত দ্য ডেইলি স্টার পড়তাম। সেই সংবাদপত্রের কাছ থেকে প্রাপ্ত এই সম্মাননা আমার জন্য আবেগঘন ও বিশেষ একটি প্রাপ্তি। তবে আমি মনে করি, এই সম্মাননা কেবল আম্বারীন রেজার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি আমার বিশাল দলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। আমাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন অনেক রাইডার, হাজার হাজার রেস্টুরেন্ট পার্টনার ও উদ্যোক্তার। এ পুরস্কার আমাদের দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে যখন আমরা বাংলাদেশকে একটি স্মার্ট ইকোনমিতে রূপান্তরের কথা বলছি, তখন এ ধরনের স্বীকৃতি আমাদের শিল্পে আধুনিক ও মানসম্মত গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করতে নতুন জ্বালানি হিসেবে কাজ করবে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশের আইসিটি খাতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো নগণ্য। আপনার এই দীর্ঘ পেশাজীবন কি অন্য নারীদের জন্য কোনো বার্তা বহন করছে?
আম্বারীন রেজা: যখন আমার ১৬-১৭ বছর বয়স, তখন থেকেই আমি কাজ শিখছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সহকারী বা টিউটর হিসেবে কাজ করা থেকেই আমার কাজের জীবন শুরু। এক দশকের বেশি সময় ধরে আমি এ দেশের প্রযুক্তিশিল্পে কাজ করছি। বাস্তবতা হলো, এখনো আমাদের দেশে নারী নির্বাহীর সংখ্যা খুবই কম। একজন নারীকে কর্মক্ষেত্রে কেবল কর্মজীবী নয়, বরং একজন ওয়ার্কিং মাদার হিসেবে ঘরে-বাইরে সমান পারদর্শিতা দেখাতে হয়। এখানে সমাজ ও সিস্টেমের কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। আমি মনে করি, চ্যালেঞ্জ থাকবেই, কিন্তু মাইন্ডসেট বা কিছু করার আগ্রহ থাকলে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা জয় করা সম্ভব। আমি চাই, নতুন প্রজন্মের নারীরা কেবল প্রযুক্তির ব্যবহারকারী নয়, বরং উদ্যোক্তা হিসেবে সামনে আসুক।
ফুডপ্যান্ডা এখন কেবল খাবার সরবরাহের অ্যাপ নয়, এটি একটি জীবনযাপনের অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে এই বিবর্তন কি সত্যিই একটি সফল মডেল?
আম্বারীন রেজা: আমরা যখন শুরু করি, লক্ষ্য ছিল কেবল খাবার সরবরাহ। গত এক যুগে অ্যাপনির্ভর ফুড সরবরাহ খাতে গ্রাহক ও সেবা বেড়েছে কয়েক গুণ। আজ আমরা প্যান্ডামার্ট ও বিভিন্ন সুপারস্টোর ও দোকানের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ইকোসিস্টেম তৈরি করেছি। ফুডপ্যান্ডা এখন একটি ব্র্যান্ড নয়, বরং একটি ক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। মানুষ এখন বলছে, খাবারটা ফুডপ্যান্ডা করে দাও। তবে খাবারের ডেলিভারি করা পৃথিবীর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজগুলোর একটি। অন্য সব ই-কমার্স পণ্য আপনি চাইলে আজ না দিয়ে কাল দিতে পারেন বা ফেরত নিতে পারেন, কিন্তু খাবারের ক্ষেত্রে সময় ও গুণমান বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আজ গৃহিণীরা ঘরে বসে কেক বা পছন্দের খাবার বিক্রি করছেন। আমরা আসলে ডিজিটাল উদ্যোক্তা তৈরির একটি শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরি করেছি, যা ঢাকার বাইরেও বিকেন্দ্রীভূত হচ্ছে। কদিন আগে রাজশাহী থেকে একজন নারীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি রাজশাহীতে ফুডপ্যান্ডার মাধ্যমে কেক বিক্রি করেন। তিনি মাসে ৫০ হাজার টাকার বেশি পণ্য বিক্রি করেন। তাঁর ব্যবসাকে আরও বড় করার জন্য তিনি ঢাকা থেকে কেক তৈরির সরঞ্জাম কিনে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের বাজার আসলে বৈশ্বিক দৃষ্টিতে দেখলে ছোট; কিন্তু চ্যালেঞ্জ আছে অনেক। প্রায় ১৭ কোটির বিশাল জনসংখ্যা এবং ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখানে বড় সম্ভাবনার। এখানে ব্যবসার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো কার্যকর লজিস্টিকস অবকাঠামো ও তীব্র যানজট। এ ছাড়া ক্যাশ অন ডেলিভারির ওপর নির্ভরতা, ডিজিটাল স্বাক্ষরতার অভাব ও ডিজিটাল পেমেন্ট গেটওয়ের সীমাবদ্ধতা ই-কমার্সের প্রসারে বাধা সৃষ্টি করে। এসব প্রতিকূলতা নিয়েই আমাদের কাজ করতে হচ্ছে।
রাইডাররা আপনার প্ল্যাটফর্মের প্রাণ। কিন্তু তাঁদের নিরাপত্তা ও পেশাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রায়ই সমালোচনা হয়। এই বিশাল তরুণ জনবলকে দক্ষ ও নিরাপদ রাখতে আপনাদের বিশেষ কোনো উদ্যোগ আছে কি?
আম্বারীন রেজা: এখন ৩০টি জেলায় আমাদের রাইডাররা ফুডপ্যান্ডার কার্যক্রমে দারুণ ভূমিকা রাখছেন। চট্টগ্রামে যান কিংবা সাতক্ষীরায় যাবেন, সেখানে আমাদের অ্যাপের মাধ্যমে দারুণ সব খাবার গ্রহণ করতে পারবেন। আমাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন অনেক তরুণ, যাঁরা সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নিজের পছন্দমতো সময়ে সেবা দেন। আমরা তাঁদের কেবল ডেলিভারিম্যান হিসেবে দেখি না। আমাদের রাইডারদের প্রায় সবাই তরুণ। আমাদের রাইডারদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। রাইডারেরা ইচ্ছা করলে বিভিন্ন প্ল্যাটর্ফম থেকে লাইফ ইনস্যুরেন্স কাভারেজ, চিকিৎসকের সহায়তা ও ভিডিও কনসালটেশন, এআইভিত্তিক স্বাস্থ্য পরামর্শের সুবিধা নিতে পারছেন কম দামে। সহজ কিস্তিতে ই-বাইক কিনতে পারছেন। বিশেষ ছাড়ে বহুব্রীহি থেকে দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কোর্স করার সুযোগ রয়েছে।
একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়, আপনারা গভীর রাত পর্যন্ত সেবার কথা বললেও ১১টার পর অনেক এলাকাতেই অ্যাপে রেস্টুরেন্ট পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে কি অবকাঠামোগত কোনো সীমাবদ্ধতা কাজ করছে?
আম্বারীন রেজা: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সমালোচনামূলক প্রশ্ন। দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক দেশেই রেস্টুরেন্ট দুই শিফটে চলে, কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এক শিফটের সংস্কৃতি প্রবল। অন্য সব দেশের চেয়ে এখনকার বাজার বেশ ছোট। এখানে আমরা সকালের নাশতা কিন্তু হোটেল থেকে খাবার কিনে এনে করি না। আমাদের দুপুর ও রাতের খাবারের জন্য অ্যাপের ব্যবহার বেশ বাড়ছে। বিভিন্ন উৎসবের সময় অ্যাপের ব্যবহার বাড়ছে। গ্রাহকের চাহিদা থাকলেও অনেক হোটেলমালিক রাত ১০টার পর রান্নাঘর বন্ধ করে দেন। এ ছাড়া অনেক এলাকায় রাতে চলাচলের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব থাকায় আমরা রাইডারদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে চাই না। তবে আমি নিজে গ্রাহকদের সব অভিযোগ ও পরামর্শ পড়ে থাকি। আমরা চেষ্টা করছি রেস্টুরেন্ট পার্টনারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নৈশকালীন সেবার মান আরও বাড়াতে। গ্রাহক যদি সেবা পেতে সমস্যায় পড়েন, তবে সেটি আমাদের ব্যর্থতা এবং আমরা তা সংশোধনে কাজ করছি। আমরা দেশে প্রথম বাইসাইকেলের মাধ্যমে ফুড ডেলিভারি দেওয়া শুরু করি। প্রথম দিকে এ দেশে ফুড ডেলিভারি মানেই ছিল মোটরসাইকেলে খাবার দেওয়া। এখন ওয়াকার, মানে পায়ে হেঁটেই আমাদের রাইডাররা খাবার দিয়ে আসছেন গ্রাহকদের কাছে। আমরা দ্রুতগতিতে খাবার পৌঁছে দেওয়ার যত চ্যালেঞ্জ আছে, সব জয় করার বিষয়ে কাজ করছি।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি রেস্তোরাঁগুলোর ব্যবসায়িক মুনাফার ক্ষেত্রে ফুডপ্যান্ডা কি আদৌ সহায়ক?
আম্বারীন রেজা: আমরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল সক্ষমতা দিচ্ছি। আমাদের অ্যাপ ব্যবহার করে একটি ছোট রেস্টুরেন্ট বা ঘরের রান্নার ব্যবসা এমন সব এলাকায় পৌঁছাতে পারছে, যেখানে তারা আগে চিন্তাও করতে পারত না। এতে তাদের স্কেলেবিলিটি বাড়ছে। কাগুজে কোনো ঝামেলা ছাড়াই একজন নারী উদ্যোক্তা আজ রান্নাঘর থেকে ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু করছেন। আমাদের লক্ষ্য কেবল কমিশন নয়, বরং তাঁদের খাবারের মানোন্নয়ন ও বিপণনকৌশল শেখানো। আমরা তাঁদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এমনভাবে অভ্যস্ত করেছি, যাতে তাঁরা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, দেশের মানুষকে আরও কম মূল্যের ইন্টারনেট–সেবার আওতায় আনা প্রয়োজন। আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক হলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরও বেশি স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট–সেবা দেওয়া উচিত। কম দামের স্মার্টফোনের মাধ্যমে আরও অনেক বেশি মানুষকে অ্যাপভিত্তিক জীবনযাত্রার মধ্যে যুক্ত করা যেতে পারে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।
আম্বারীন রেজা: বিশ্বের অনেক দেশেই এখন ড্রোন ডেলিভারি নিয়ে কাজ চলছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও আমরা এর পরীক্ষা চালাতে চাই। আমাদের এখনকার পরিকল্পনা হলো প্রতিদিন এক কোটি অর্ডার ডেলিভারি করার মতো সক্ষমতা অর্জন করা। এর জন্য আমরা এআই ব্যবহার করে গ্রাহকের পছন্দ নিয়ে কাজ করছি। প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন আমাদের শিখিয়েছে যে যা আজ অসম্ভব মনে হয়, কাল তা-ই স্বাভাবিক। আমরা আমাদের লজিস্টিকসকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যেখানে রোবোটিকস বা ড্রোনের ব্যবহার কেবল বিলাসিতা নয়; বরং প্রয়োজনের তাগিদে ব্যবহৃত হবে।
নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য কী বলবেন? বাংলাদেশের এই অস্থিতিশীল বাজার ও চ্যালেঞ্জের মধ্যে টিকে থাকার মূলমন্ত্র কী?
আম্বারীন রেজা: আমি সব সময় বলি, যেখানে চ্যালেঞ্জ বেশি, সেখানে সম্ভাবনাও বেশি। আমাদের দেশের সমস্যাগুলোই হলো উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন স্টার্টআপ তৈরির ক্ষেত্র। উদ্যোগ শুরু করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট বয়স বা বিশাল পুঁজির প্রয়োজন নেই। আপনার হাতের স্মার্টফোনটিই এখন একটি শক্তিশালী মাধ্যম। নিজের চারপাশের কোনো একটি ছোট সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করুন, ব্যবসাই আপনাকে খুঁজে নেবে। শুধু মনে রাখবেন, প্রযুক্তির সঙ্গে সততা ও ধৈর্য থাকলেই আপনি সফল হবেন।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আম্বারীন রেজা: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।