পড়ুন, কীভাবে মাত্র ৪০ টাকায় এক হালি ইলিশ কিনলেন রাজীব হাসান
মাস চারেক আগের কথা। আমার মেয়ে ঋদ্ধিকে স্কুলে ভর্তি করানোর প্রস্তুতি চলছে। ওর মা দেখি একগাদা বই কিনে এনেছে। বড় বড় ছবিওলা আট পৃষ্ঠার শক্ত কাগজের রঙিন বই। একটা বইয়ে ফুলের নাম। একটায় ফলের নাম। একটায় গাড়িঘোড়ার নাম। একটায় পশুপাখির নাম। একটায় মাছের। একটু বিরক্তই হলাম। ছোট্ট মেয়েটার জন্য চার-চারটা বই! এত্তটুকুন মেয়েকে এখনই এত এত বইয়ের চাপে ফেলে ওর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ...একটা জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। বউ থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঋদ্ধির জন্য একটা বই, বাকি তিনটা তোমার।’
আমার বিয়েটা একটা দুর্ঘটনা। এর চেয়েও বড় দুর্ঘটনা হচ্ছে আমার প্রেম। তখন শীতকাল। রংপুরে শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়ে। শীত হচ্ছে সবজি আর প্রেমের বাম্পার ফলনের মৌসুম। পরিচিত বন্ধুরা সব টপাটপ করে প্রেমে পড়ছে। আমারও তো ইচ্ছে করে, সখী, আমারও তো ইচ্ছে করে! একদিন কলেজে যাওয়ার পথে দেখি পৌরবাজারের সামনে বেশ সুন্দর দেখতে একগাদা ফুল বিক্রি হচ্ছে। দামও তেমন নয়। আমি দেখতে বড়সড় একটা ফুল নিয়ে কলেজে হাজির। এত বড় ফুল লুকিয়ে রাখা যায় না। কোনো এক মনীষী বলেছেন, প্রেম আর ব্রণ লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। প্রেম মনে হয় মানুষকে একই সঙ্গে বোকা আর সাহসী করে তোলে। আমার সদ্য উঁকি দেওয়া উসখুস ব্রণের মতো প্রেমটার যন্ত্রণাতেই হোক, ভীষণ রকমের সাহসী কিংবা বোকা এই আমি পুলিশ লাইন কলেজের পুলিশি প্রহরা অগ্রাহ্য করে দৃপ্ত ভঙ্গিতে সেই ইয়া বড় ফুল হাতে নিয়ে কলেজে ঢুকে গেলাম। হিরো হিরো কায়দায় হাঁটু গেড়ে বসলাম বীথির সামনে। তুলে দিলাম সেই ধূসর-সাদা রঙের ফুল। আশপাশে সবাই বড় বড় চোখ করে তাকাচ্ছে। সবাই অবাক, সবাই ভাবে ব্যাপারখানা কী, ভয়কাতুরে রাজীব আজ এমন সাহসী!
বীথির চোখ এমনিতেই রসগোল্লার মতো। আমার হাতের ফুল দেখে সেগুলো Full সাইজ ধারণ করল। হাত থেকে সেই ভারী, ওজনদার ফুলটা নিয়ে আমার দিকেই ছুড়ে মেরে বীথি বলল, ‘গাধা, ফুলকপি দিয়ে কেউ প্রেম নিবেদন করে, You fool!’
সখী, পশ্চাতের ‘কপি’টাই দেখিলে, অগ্রের ‘ফুল’টা দেখিলে না? সেদিনই জানলাম সব ফুল ‘ফুল’ না। আমি আসলে এতটাই গবেট; ফুল, পাখি, মাছ কিছুই ঠিকমতো চিনি না। এখনো না। আমার জন্য বউয়ের ফুল, মাছ, পাখি বই চেনার বই কিনে আনার রহস্য এটাই। সেদিনের কথা বলি। আট বছরের সংসার-জীবনে ঠেকে ঠেকে অনেক শিখেছি। বাজারে গিয়েই হুট করে কিছু কিনতে নেই। অনেকক্ষণ ধরে দেখে-শুনে কিনতে হয়। আমিও কোমরে হাত দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভাবছি। জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব করে বললাম, ‘ভাই, শিং মাছের কেজি কত? দেশি শিং তো? দেখে তো মনে হচ্ছে থাই শিং।’
মাছওয়ালা হাই তুলে বলল, ‘ভাই, এইগুলান শোউল মাছ।’
আশ্চর্য, শিং আর শোল মাছ একই রকম দেখতে হলে আমার দোষ? আমার বউকে কে বোঝাবে বলেন? একবার না বুঝে সমুদ্রের কী যেন মাছ কিনে এনেছিলাম। এরপর থেকে বাজারে গেলে সাবধান করে দেয়, ‘খবরদার, সমুদ্রের মাছ কিনবা না। নদী কিংবা পুকুরের মাছ কিনবা।’
সক্রেটিসও বউয়ের অবাধ্য হতেন না। আমিও মাছ কেনার সময় ভালো করে খোঁজ নিই, এটা সমুদ্রের কি না, ‘ভাই, টেংরাগুলা তো দেখতে ভালোই মনে হচ্ছে, কিন্তু সমুদ্রের টেংরা না তো? ভাই, ইলিশগুলা পুকুরের তো?’
ভালো কথা, ইলিশ বলতেই মনে পড়ে গেল, এ নিয়ে কদিন আগে কী কাণ্ডটাই না হলো! টিভিতে দেখলাম, এক হালি ইলিশের দাম নাকি ৪০ হাজার টাকা! দামের চেয়েও বেশি বিস্মিত হলাম দেখে, কিছু কিছু লোক পাগলের মতো সেগুলো কিনছেও! ভাই ইলিশ, এত দিন তুই কোথায় ছিলিশ! রুপালি ইলিশ বলার দিন শেষ। এখন বলতে হবে হীরার কিংবা প্লাটিনামের ইলিশ! ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল, ইলিশ না কিনলে আর মান-ইজ্জত বাঁচানো যাচ্ছে না। গরিবের জীবনের চেয়ে ইজ্জতের দাম অনেক বেশি। আমিও তাই এক হালি ইলিশ কেনার জন্য বাজার অভিমুখে চললাম।
‘ভাই, ইলিশের হালি কত?’ কোমরে হাত দিয়ে বেশ বিজ্ঞের মতো জানতে চাইলাম।
মাছওয়ালা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘কী কন ভাই, এইগুলান তো পুঁ...।’ আমি তাকে কথা শেষ করতে দিলাম না। মুখের ওপর বিশ টাকার দুটি নোট ছুড়ে ফেলে এক এক হালি ‘ইলিশ’ কিনে বাড়ি ফিরলাম। এবং কী আশ্চর্য, এই প্রথম আমার বিবাহিত-জীবনের ক্যারিয়ারে ভুল মাছ কিনে আনা নিয়ে বউ কোনো গঞ্জনাও দিল না! মেয়ের প্রথম পর্ব পরীক্ষা চলছে। সেদিন দেখি মেয়েকে তার মা পড়াচ্ছে, ‘আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আর জাতীয় মাছ...পুঁটি!’