উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর বরফ গলার ফলাফল কতটা ভয়ংকর

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, ২০৫০ সালের মধ্যে এ উষ্ণতা বৃদ্ধির হার যদি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে না পারি, তাহলে বিশ্বে এমন ওলট–পালট শুরু হবে, যা আর সহজে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। উষ্ণতা বৃদ্ধির হার বলতে বোঝানো হয়, ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের সময় বৈশ্বিক গড় উষ্ণতা, যা ছিল তার তুলনায় এখন কতটা বেশি। ২০৫০ সালের মধ্যে যেন দেড় ডিগ্রির মধ্যে ধরে রাখা যায়, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সব দেশের বা সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এটা সম্ভব নয়। কয়লা, তেলসহ জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে আমরা শিল্পপণ্য উৎপাদন করছি, বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি, আর অন্যদিকে ক্রমাগত বন উজাড় হচ্ছে।

বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড তাপ ধরে রাখে বলেই বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়ে। তাই কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা এখন জরুরি। সৌরবিদ্যুৎ, পানিবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ প্রভৃতি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে আমরা এটা করতে পারি।

সমস্যা হলো, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অগ্রগতি থাকলেও কড়াকড়িভাবে কার্বন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এখনই বৈশ্বিক গড় উষ্ণতা বৃদ্ধির হার দেড় ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে বলে অনেক বিজ্ঞানী হিসাব করে দেখেছেন। তাই সচেতন উদ্যোগ ছাড়া মহাবিপদ। যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হই, তাহলে ২০৫০ সালের পর ধীরে ধীরে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা।

প্রধান লক্ষণ কী

মহাবিপদ ইতিমধ্যেই দেখা দিতে শুরু করেছে। প্রধান লক্ষণ হলো পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর পরিস্থিতি। সেখানে জমাটবাঁধা বরফ ক্রমে গলে যাচ্ছে। তা ছাড়া আবহাওয়া উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে। শীতের সময় গরম, গরমের সময় শীত, অসময়ে বন্যা প্রভৃতি ঘটেই চলেছে। পত্রিকায় তো প্রায়ই খবর বের হয় যে গ্রিনল্যান্ডে বরফ গলছে। বড় বড় বরফের চাঁই ধসে পড়ছে। এ কারণে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির আশঙ্কাও বিজ্ঞানীরা করছেন। কারণ, বরফগলা পানি সাগর-মহাসাগরে মিশবে এবং এই বরফ গলা চলতে থাকলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমুদ্র উপকূলের অনেক এলাকা পানির নিচে চলে যেতে পারে। এর প্রভাবে শুধু যে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা-ই নয়, আরও অনেক ধরনের বিপদ আসবে।

সমুদ্রের প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব

সমুদ্রের কোনো কোনো প্রজাতির মাছের টিকে থাকা কঠিন হবে। কারণ, এখন সমুদ্রের যে অঞ্চলে যে ধরনের তাপমাত্রায় মাছের বিভিন্ন প্রজাতি স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়, পানির উষ্ণতায় পরিবর্তন ঘটলে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অনেক প্রজাতির মাছ হয়তো সমস্যায় পড়বে, কিছু প্রজাতির মাছ বিলুপ্তও হতে পারে।

সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা

সমুদ্রতলের উচ্চতা বাড়লে উপকূলীয় অঞ্চলের নদীর পানি অনেক ভেতর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে। এ কারণে দুই ধরনের সমস্যা দেখা দেবে। প্রথমত, উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির অভাবে মানুষের বসবাস সমস্যার মুখে পড়বে। আর দ্বিতীয়ত, উপকূলে নদীর স্রোতের তীব্রতা কমে যাবে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে নদীর মোহনায় পলি বেশি জমবে।

কয়েক বছর আগে, ২০০৭ সালে আমরা কয়েকজন সিডরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিধ্বস্ত এলাকায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আশ্রয়কেন্দ্র পুনর্নির্মাণ উপলক্ষে সাতক্ষীরায় যাই। সে সময় এলাকার মানুষ আমাদের সমুদ্র উপকূলে একটি উপনদীর দুই পার মাটি জমে কীভাবে উঁচু হয়ে উঠেছে, সেটা দেখিয়ে বলেন, ওই অঞ্চলে নদীর স্রোত কমে আসছে। তাই পলি জমে দুই ধার উঁচু হয়ে যাচ্ছে। এর বহুমুখী প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া তাঁরা দেখছেন।

এলাকাবাসী বলেন, নদীর পানি এত লবণাক্ত যে দু-চার মাইল ভেতরও সুপেয় খাওয়ার পানি নেই। বাঁধের ভেতরে যে একটি পুকুর ছিল, তা ঘূর্ণিঝড়ে সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে ভরে গেছে। আমরা স্থানীয় মানুষ ও একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় সেই পুকুরের লবণাক্ত পানি সম্পূর্ণ সেচে ফেলে পরে বৃষ্টির পানি দিয়ে ধীরে ধীরে ভরে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করি। ওই পুকুরের পানি ব্যবহার করেই চারপাশের কয়েক বর্গমাইল এলাকার মানুষ খাওয়া ও রান্নার কাজ করে।

কয়েক বছর আগে জানতে পারি, যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাঙালি কয়েকজন গবেষক দেশে এসেছেন। তাঁরা নদীর পানি কত দূর পর্যন্ত লবণাক্ত, তা পর্যবেক্ষণ করেন। একপর্যায়ে তাঁরা দেখেন, এমনকি গোয়ালন্দ পর্যন্ত এলাকায় নদীর পানি কিছুটা লবণাক্ত। এ গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ ধরনের প্রভাব লক্ষণীয়।

উপকূলীয় বনাঞ্চল

আমাদের সুন্দরবনের গাছপালাও ক্রমে কমে যাচ্ছে। দুটি কারণ। প্রথমত, মানুষ বসতি স্থাপনের জন্য বন উজাড় করছে, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এ অঞ্চল প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় ও প্রতিকূল আবহাওয়ার শিকার হচ্ছে। বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাঘ-হরিণ ও অন্যান্য প্রাণীও বিপন্ন হচ্ছে। আমাদের গর্বের বেঙ্গল টাইগার আজ বিলুপ্তির পথে।

সমুদ্রতলের উচ্চতা

সম্প্রতি কোরা ওয়েব পেজে প্রকাশিত একটি প্রশ্নের উত্তরে মাইকেল ব্রস লিখেছেন, বিজ্ঞানীদের ধারণা, শুধু গ্রিনল্যান্ডের হিমবাহের সব বরফ গলে গেলে মহাসাগরের পানির উচ্চতা প্রায় সাড়ে সাত মিটার বেড়ে যাবে। আর যদি দক্ষিণ মেরুর সব বরফ গলে যায়, তাহলে আরও ৫৮ মিটার উচ্চতা বাড়বে। কারণ, দক্ষিণ মেরুর বরফখণ্ড প্রায় দুই কিলোমিটার পুরু। গ্রিনল্যান্ডের প্রায় সাত গুণ বেশি জমাটবাঁধা বরফ সেখানে আছে।

তাহলে বলা যায়, দুই মেরুর জমাট বরফ সম্পূর্ণ গলে গেলে হয়তো সাগরতলের উচ্চতা মোট ৬৫ মিটার বা প্রায় ২১৩ ফুট বাড়বে! হয়তো এ অবস্থায় যেতে অনেক সময় লাগবে। কারণ, হুট করে তো আর সব বরফ গলে যাবে না। কিন্তু আমরা যদি এখনো সচেতন না হই, তাহলে এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি আমাদের ভোগ করতে হবে।

এখন হিসাব করে দেখতে হবে, যদি সত্যিই সেই অবস্থার মুখোমুখি আমাদের হতে হয়, তাহলে বিশ্বের কতগুলো দেশের কতটা উপকূলীয় অঞ্চল সাগরের পানিতে ডুবে যাবে। নিশ্চয়ই বিশ্বের সব দেশ ডুবে যাবে না। কিন্তু বিভিন্ন দেশের উপকূলীয় অঞ্চল কতটা ডুববে?


এ বিষয়ে আমরা পরবর্তী সময়ে আলোচনা করব।

*লেখক: আব্দুল কাইয়ুম, বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক ও প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]