জুম ও নেটফ্লিক্সের উত্থান

জুম

করোনাকালের ঘরবন্দী সময়ে অনেকেই চোখ রেখেছিলেন নেটফ্লিক্সের পর্দায়। সরাসরি দেখাদেখিতে যখন মনে ভয় তৈরি হয়েছিল, তখন জুম ভিডিও কনফারেন্সে করেছেন পারস্পরিক যোগাযোগ। করোনার এ সময়ে দূরে থেকেও কাছে থাকার অনুভূতি দিয়েছে ডিজিটাল এসব প্ল্যাটফর্ম। মানুষের ডিজিটাল সেবার অভ্যস্ততার সুবাদেই তরতর করে উত্থান ঘটেছে জুম আর নেটফ্লিক্সের।

করোনাকাল মানুষের জীবনে নানা পরিবর্তন এনেছে। বদলে গেছে ব্যবসা, যোগাযোগ, বিনোদন ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ধরন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, মহামাররি সময়টাতে বিশ্বে ডিজিটাল রূপান্তরের যাত্রায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে ভিডিও কনফারেন্সিং সেবা জুম ও বিনোদন প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্স। বিশ্বজুড়ে লকডাউনের সময় ১০০ কোটির বেশি মানুষ বাড়ি থেকে কাজ করার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করেছে। এর ফলে বিশ্বে ডিজিটাল রূপান্তর আরও ৩ থেকে ৫ বছর ত্বরান্বিত হয়েছে।

২০১৯ সালে যেসব ট্রেন্ড বা চল নতুন বছরে জারি থাকবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছিল, তা ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে। প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোনো চিন্তাভাবনা ছেড়ে নতুন ধরনের কর্মপরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করে। এ সময় ফেসবুক, গুগল, মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজের সুযোগ করে দেয়। টুইটারের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীরা যেন চিরকাল বাড়ি থেকে কাজ করতে পারে তার ঘোষণা দিয়ে দেয়। উল্টো দিকে আবার অনেক প্রতিষ্ঠান করোনার কারণে বন্ধ হয়ে যায় বা কর্মী ছাঁটাই করতে শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বেড়ে যায় জুম এবং মাইক্রোসফটের টিমের পণ্যের চাহিদা। লকডাউন শুরু হলে গত মার্চ মাসের তিন সপ্তাহে জুম ব্যবহারকারী ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। একই সময় মানুষ সময় কাটানোর জন্য বিনোদন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নেটফ্লিক্সের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্র্যান্ডিং সংস্থা এমব্লেম তাদের এক গবেষণা নিবন্ধে জানায়, মহামারির সময় জুম ভিডিও এবং নেটফ্লিক্স ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। সংস্থাটির ‘২০২০ ব্র্যান্ড ইনটিমেসি কোভিড স্টাডি’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মহামারির প্রথম দিকে সামাজিক দূরত্ব এবং ঘরে থেকে কাজের মতো বড় পদক্ষেপের প্রেক্ষাপটে ব্যাপক আকারে জুম ব্যবহার শুরু করে মানুষ।

যোগাযোগে নির্ভরযোগ্য জুম

মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুক, টুইটারকে আপন করে নিয়েছ। বেড়েছে ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং সেবাগুলোর ব্যবহারও। কিন্তু ছোট ছোট ব্যবসা ও গ্রুপ ভিডিও কনফারেন্সের ক্ষেত্রে গত বছর থেকেই জুমের ব্যবহার বাড়ছিল। করোনাকালে সহজ ভিডিও যোগাযোগব্যবস্থা হিসেবে জুমে ঝুঁকে পড়ে বিশ্বের অনেক মানুষ। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় সিসকো ওয়েবেক্সে (সিসকোর ভিডিও কনফারেন্স শাখা) কর্মরত এরিক ইউয়ান নামের এক চীনা বংশোদ্ভূত প্রযুক্তিবিদ চাকরি ছেড়ে ‘সাসবি’ নামের একটি ভিডিও কনফারেন্স সিস্টেম তৈরি করে বাজারজাত করার চেষ্টা করেন। এরিক ইউয়ান প্রথমে তেমন একটা সুবিধা করতে না পারলেও পরের বছর নাম পাল্টে ও পুরোনো কর্মস্থল সিসকোর কর্মকর্তাদের সহায়তায় আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে ‘জুম ভিডিও কমিউনিকেশনস’ নামে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে এই কোম্পানির কর্মীসংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর ব্যবহারকারী দাঁড়ায় ২২ লাখ। করোনা পরিস্থিতিতে হোম অফিস ও আন্তযোগাযোগের ব্যাপকতার ফলে এপ্রিল মাসে এর দৈনিক ব্যবহারকারী বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ কোটিতে। পৃথিবীর অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন শিক্ষা কাজেও জুম প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার শুরু করে। করোনার সময়ে ব্যাপক আয়ও বেড়েছে জুমের। পাশাপাশি এতে নানা পরিবর্তনও এনেছে কর্তৃপক্ষ।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, মহামারির সময় স্কুল ও অফিসের কাজ ঘরে বসে করায় গত প্রান্তিকে রেকর্ড আয় করেছে জুম। ব্যবহারকারী বাড়ার সুযোগটিকে ধরে রাখতে বিনা মূল্যে বিশেষ সেবা দিতে শুরু করে জুম কর্তৃপক্ষ। এ বছরে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর তিন মাসে ৭৭ কোটি ৭২ লাখ মার্কিন ডলার আয় করেছে জুম, যা এক বছর আগে এই সময়ে আয় ছিল মাত্র ১৬ কোটি ৬৬ লাখ মার্কিন ডলার। এক প্রান্তিকেই তাদের মোট লাভের পরিমাণ ১৯ কোটি ৮৪ লাখ মার্কিন ডলার। বাজার বিশ্লেষকেরা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, এ প্রান্তিকে ১৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার মুনাফা করতে পারে জুম। বিশ্লেষকদের সে পূর্বাভাস ছাড়িয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি।

জুমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এরিক ইউয়ান বলেছেন, ‘গ্রাহক ও কমিউনিটির প্রয়োজনের বিষয়ে আমরা মনোনিবেশ করে থাকি, যাতে তাঁরা বর্তমান পরিবেশে মানিয়ে নিতে জুম ব্যবহার করে যেকোনো জায়গা থেকে কাজে যুক্ত হতে পারেন। বছর শেষে বাজারে জুমের অবস্থান আরও শক্তিশালী করার আশা রাখছি।’

ভিডিও কনফারেন্সিং সেবা হিসেবে করপোরেট খাতের বিজয়ী বলা যায় জুমকে। অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের ভিডিও কনফারেন্সিং সেবার জন্য জুম ভিডিও সেবা ব্যবহার করছে। এর বাইরে স্কুলের শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের ঘরবন্দী জীবনকে সহজ করেছে জুম। ভিডিও সেবার এ জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো জুমকে ঘিরে প্রতিযোগিতাও শুরু করেছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সহজ করতে মাইক্রোসফট ও ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠান নতুন নতুন সেবা চালু করেছে। জুমের সুবিধা হচ্ছে তাদের পেইড সাবসক্রাইবার বা অর্থ খরচ করে সেবা গ্রহণকারী বাড়ছে। জুমের তথ্য অনুযায়ী, ১০ জনের বেশি কর্মী রয়েছে এমন ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৭০০ প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহক। এরা অর্থ খরচ করে জুম ব্যবহার করে থাকে। বছরে ১ লাখ ডলারের বেশি খরচ করে এমন গ্রাহকের সংখ্যাও এক বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে তাদের।

গত মাসে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল টেক লাইভ সম্মেলনে জুমের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা অপর্ণা বাওয়া বলেন, জুম তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির বিষয়টি কীভাবে বিস্তৃতভাবে কাজে লাগানো যায়, তা ভাবছে। এর বাইরে ক্ষুদ্র গ্রাহকদের লক্ষ্য করে কীভাবে ভালো সেবা দেওয়া যায়, সেদিকটিও দেখছে।

সব চোখ নেটফ্লিক্সে

ছবি: ইনস্টাগ্রাম

গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গরম করে রাখে নেটফ্লিক্সের একটি সিনেমা, এক্সট্রাকশন। এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন ক্রিস হেমসওর্থ। করোনার সময়টাতে এ ধরনের চলচ্চিত্র নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়ায় মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অনলাইন ভিডিও প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সের ব্যাপক চাহিদা লক্ষ করা যায় মানুষের ঘরবন্দী সময়ে। চলতি বছরের শুরুতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকেই বেছে নিতে হয় ঘরবন্দী জীবন। একসময় ঘরে থেকেই অনলাইনে শুরু হয় অফিসের কার্যক্রম, স্কুলের পাঠ্যক্রম। প্রয়োজন পড়ে বিনোদনেরও। তাই ব্যাপক চাহিদা দেখা যায় নেটফ্লিক্সের।

ব্র্যান্ডিং সংস্থা এমব্লেম বলছে, কোভিডের আগেই শক্তিশালী ব্র্যান্ড ছিল নেটফ্লিক্স। মহামারির সময় ব্র্যান্ডটির ব্যবহার আরও বেড়ে যায়। অবসর কাটাতে এ প্ল্যাটফর্মের কনটেন্ট দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন অনেকেই। এর প্রভাব দেখা যায় নেটফ্লিক্সের আয়ে। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ, এপ্রিল থেকে জুন এ তিন মাসে ৬১০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করে নেটফ্লিক্স, যা গত বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। এ সময় ২৭ শতাংশ গ্রাহক বৃদ্ধি ঘটে নেটফ্লিক্সে। ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে মধ্যে নেটফ্লিক্স ২ কোটি ৫৯ লাখ গ্রাহককে যুক্ত করেছে। ২০১৯ সালজুড়ে নেটফ্লিক্সে মোট গ্রাহক যুক্ত হয়েছিল ২ কোটি ৮০ লাখ।
নেটফ্লিক্স ইনকরপোরেশন যুক্তরাষ্ট্রর ওভার-দ্য টপ কন্টেন্ট প্ল্যাটফর্ম এবং প্রযোজনা সংস্থা হিসেবে পরিচিত। এর সদর দপ্তর ক্যালিফোর্নিয়ায়। ১৯৯৭ সালের ২৯ আগস্ট রিড হ্যাস্টিংস এবং মার্ক রেন্ডোলফ নেটফ্লিক্স প্রতিষ্ঠা করেন। এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১৯ কোটি ৫০ লাখ পেইড সাবসক্রিপশন রয়েছে নেটফ্লিক্সের, যার মধ্যে ৭ কোটি ৩০ লাখ যুক্তরাষ্ট্রের। ডিভিডি বিক্রি ও ভাড়া দিয়ে নেটফ্লিক্সের ব্যবসা শুরু হলেও ২০১১ সালে অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং ব্যবসায়ে নামে নেটফ্লিক্স। এর গ্রাহকেরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেখতে পারেন নতুন নতুন ছবি বা টিভি সিরিজ। এ জন্য প্রতি মাসে মূল্য পরিশোধ করতে হয়। করোনা পরিস্থিতিতে নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির বিষয়টি তাদের ইতিবাচক পরিবর্তনের সঙ্গে মানানসই হয়েছে। সময় ও প্রযুক্তির বিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই তৈরি হয়েছে আজকের নেটফ্লিক্স, যা এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে।
নেটফ্লিক্স চলেই এর কনটেন্ট দিয়ে। নেটফ্লিক্সের চ্যালেঞ্জ তাই নতুন কনটেন্ট। এ বছর লকডাউনের কারণে সিনেমা ও টিভি নাটক তৈরির সংখ্যা ব্যাপক কমে গেছে। এখন নেটফ্লিক্সের জন্য চ্যালেঞ্জ যে বিপুল পরিমাণ গ্রাহক সংযুক্ত হয়েছে, তাদের ধরে রাখা। অবশ্য এই উদ্বেগ নেটফ্লিক্স দেখাচ্ছে না। তারা বলতে চাইছে কনটেন্টের বিষয়ে আরও ‘ভালো ও সাবধানী’ অগ্রগতি করতে চায় তারা। কোম্পানিটি প্রত্যাশা করছে, আগামী বছর নেটফ্লিক্সের প্রযোজনার সংখ্যা প্রতি ত্রৈমাসিকে ২০২০ সালের ত্রৈমাসিককে ছাড়িয়ে যাবে।

তথ্যসূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ব্যাংকক পোস্ট