ধীরগতির ইন্টারনেট নিয়েই ফ্রিল্যান্সিং করেন গারো তরুণেরা

গভীর অরণ্যের প্রায় ১০ কিমি ভেতর অবস্থিত মধুপুর গাছাবাড়ী গ্রামে থেকেই মার্কিন প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করেন প্রাঞ্জল নকরেক। ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় গ্রামের লিচুতলায় বসে কাজ করেন তিনি।ছবি: সংগৃহীত

টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলের গায়রা, গাছাবাড়ি, ইদিলপুরসহ অনেক গ্রাম। গ্রামগুলোতে গারো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। অবাক করার বিষয় হলো এই এলাকার বেশ কিছু তরুণ-তরুণী তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। গারো তরুণ সুবীর নকরেক প্রতিষ্ঠিত ‘নকরেক আইটি ইনস্টিটিউট’ থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরাই এখন কাজ করছেন, আয়ও হচ্ছে ভালো। কিন্তু তাঁদের কাজের প্রধান সমস্যা ধীরগতির ইন্টারনেট। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ইন্টারনেট সংযোগ সচল রাখতে গ্রামগুলোতে কখনো গাছে বা কখনো ঘরের চালে মডেম ঝুলিয়ে কাজ করতে হয় ফ্রিল্যান্সারদের।
মধুপুরের এই অঞ্চলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মুঠোফোন সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন ও বাংলালিংকের মুঠোফোন ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তবে বাড়ির ভেতরে মাটির ঘরে মুঠোফোন নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না, ইন্টারনেট তো দূরের কথা। খোলা মাঠে গ্রামীণ ও বাংলালিংকের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। কখনো টুজি, আবার কখনো থ্রিজি গতি পাওয়া যায়।

মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামের দিনা মৃ
ছবি : সংগৃহীত

স্থানীয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠানের সংযোগও কেউ কেউ ব্যবহার করেন। এর গতি কমবেশি ১ এমবিপিএস পাওয়া গেলেও বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। যে কারণে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজে মুঠোফোন ইন্টারনেটে ভরসা।
কথা হয় গায়রা গ্রামের মুসলেহ উদ্দিন চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ফিলিপ মৃর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেখুন আমাদের কাজের আগ্রহ অনেক কিন্তু সুযোগ কম। শুধু ইন্টারনেটে প্রয়োজনীয় গতি না পাওয়ায় আমরা সাবলীলভাবে কাজ করতে পারছি না। যখন আগ্রহ নিয়ে কাজ করতে বসি, তখনই ইন্টারনেটের ধীরগতির জন্য কাজটা থেমে যায়। আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। অনেকে ভালো ইন্টারনেটের জন্য শহরের দিকে ছুটছেন। আমাকে তো স্কুলে পড়াতে হয়, তাই গ্রাম ছাড়তে পারি না।’

দিনা মৃ কাজ করেন ডিজিটাল বিপণন নিয়ে। বাড়ি মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামে। তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে নকরেক আইটির মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে জানতে পারি, তারপরই শুরু। করোনাকালে লকডাউনের দিনগুলোতে কাজ করেছি বাড়িতে বসে। তখন তিন মাস মধুপুর ছিলাম, একটাই সমস্যা ছিল ইন্টারনেটের গতি। কখনো মাঠে, আবার কখনো বাড়ির উঠানের আমগাছ তালায় রাউটার, মডেম ঝুলিয়ে কাজ করেছি। তা ছাড়া রাতে ফাইল পাঠাতে হলে বনের যেখানে ইন্টারনেট পেয়েছি সেখান থেকেই বিদেশে থাকা গ্রাহকের কাছে কাজ পাঠিয়েছি।’

দিনা মৃ এখন ময়মনসিংহ শহরে থেকে কাজ করছেন। ফ্রিল্যান্সিং থেকে প্রতি মাসে তাঁর প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।

ইন্টারনেটের সমস্যা মধুপুরের গায়রা, কাকড়াগুনি, বেদুরিয়া, জয়নাগাছা, সাধুপাড়া, কেজাই, জালাবাধা, চুনিয়া, লাঙ্গলভাঙ্গা, রাজবাড়ী, গেচ্ছুয়া, বেরীবাইদ, মাগন্তীনগর, জাঙ্গালিয়া, মমিনপুর, ধরাতি, গাছাবাড়ি, আমলিতলা, ভূটিয়া, জালিচিরা, পীরগাছা, বাগাডোবা, থানারবাইদ ইত্যাদি গ্রামেও। ধীরগতির ইন্টারনেটের কারণে ভালোভাবে কাজ করতে পারছেন না ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৩৫০ তরুণ-তরুণী।

মধুপুরের জলছত্র এলাকার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগদাতা কেবিজেড অনলাইনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ সরকার জানান, ‘আমরা আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে সংযোগ দিয়ে থাকি। গতি ১০ থেকে ২০ এমবিপিএস পর্যন্ত পাওয়া যায়।’

তবে ব্রডব্যান্ডের বাস্তব গতি নিয়ে ব্যবহারকারীদের অভিযোগ রয়েছে। নকরেক আইটি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সুবীর নকরেক বলেন, ব্রডব্যান্ডে ২-৩ এমবিপিএস গতি পাওয়া যায়। সেটাও খোলা মাঠে। এ জন্য মুঠোফোন ইন্টারনেটের ব্যবহার বেশি। সুবীর জানান, এই এলাকায় বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তরুণ–তরুণীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জন করেছেন। শুধু ইন্টারনেট সমস্যার কারণে তাঁরা ভালোভাবে কাজ করতে পারছেন না। যে কারণে তাঁদের শহরে যেতে হচ্ছে।