বুলবুল আহমেদ

বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের গুণী অভিনেতা বুলবুল আহমেদের জন্ম ১৯৪১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার আগামসি লেনে। বাবা খলিল আহমেদ ও মা মোসলেমা খাতুনের অষ্টম সন্তান তিনি। খলিল ও মোসলেমা দম্পতির বড় ছেলে হামেদ আহমেদের পরে ছয়টি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে, যাদের মধ্যে দুই কন্যা সন্তানের মৃত্যুতে সবাই শোকাহত ছিলেন। বুলবুল আহমেদের জন্মের পর আনন্দে আশেপাশে তবারক বিলি করা হয়। তাই শুরুতে তাঁর নাম রাখা হয় তাবাররুক আহমেদ ওরফে বুলবুল। ছবিতে অভিনয় করতে গেলে সবাই তাঁকে বুলবুল আহমেদ নামে চেনে।

ছেলেবেলায় বুলবুল আহমেদের চলচ্চিত্র দেখার শখ ছিল। একটা পর্যায়ে তা নেশার মত হলেও বড় ভাইবোনেরা তাঁকে ছবি দেখতে নিতেন না। খুব মন খারাপ করতেন, কাঁদতেনও। বাবার হাত ধরে প্রেক্ষাগৃহে লরেল হার্ডির ছবি দেখেন। তখন ঢাকার প্যারাডাইস ও ব্রিটানিয়া প্রেক্ষাগৃহে ইংরেজি ছবি দেখানো হত।

বাবার চাকরিসুত্রে বুলবুল আহমেদকে অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে। যে কারণে আগামসি লেনে জন্ম হলেও তাঁর পড়ালেখার শুরু কলকাতার মুসলিম গার্লস স্কুলে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। দেশ বিভাগের পূর্বে আবার ঢাকায় বদলি হন বাবা। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের পুরানা পল্টন শাখায় ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পর সদরঘাট শাখায় ভর্তি হন। এখান থেকে এসএসসি পাশ করেছিলেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ভর্তি হওয়ার পর ১৯৫৭ সালের ডিসেম্বরে আকস্মিকভাবে তাঁর মা মারা যান। চাকরিসূত্রে বড় ভাই হামেদ আহমেদ তখন সিলেটে। মায়ের মৃত্যুর পর ভাই তাঁকে সিলেটে নিয়ে যান। এমসি কলেজে ভর্তি করে দেন। কিছুদিন পর আকস্মিকভাবে বাবাও মারা যান। বুলবুল আহমেদের জন্যে পরপর দুটি শোক সামলে ওঠা বেশ কষ্টকর ছিল। শোক কাটিয়ে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাশ করার পর ভর্তি হন কলা শাখায় নটরডেম কলেজে।

বুলবুল আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগ থেকে এম.এ. পাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি ‘ডাকসু’ ও এসএম হল নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৬৩ সালে এম.এ. পাশ করার পর রেডিওতেও কাজ করেন তিনি। ‘অনুরোধের আসর’ নামে গানের অনুষ্ঠান দিয়েই ঘোষক হিসেবে নাম লেখান। রেডিওর টাকায় জীবন ঠিকঠাক চলছিল না বলে একটা সময় ব্যাংকের চাকরীতে আবেদন করেন। তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংক যা বর্তমানে জনতা ব্যাংক নামে পরিচিত, সেখানে শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। মতিঝিলের হেড অফিস ছিল তাঁর প্রথম কর্মস্থল। ছয় মাস পর চট্টগ্রামে বদলী হন। কয়েক মাস পর আবার ঢাকায়, তখন পদবী ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে। দশবছর ব্যাংকার হিসেবে কাজ করার পরও নাটক ছাড়েননি। মঞ্চে ও টেলিভিশনে নাটক করে গেছেন নিয়মিত।

বুলবুল অহমেদ কবিতা আবৃত্তি করতেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন চালু হওয়ার পর নিয়মিত নাটকে অভিনয় শুরু করেন। টেলিভিশনে তাঁর প্রথম নাটক আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘পূর্বাভাস’। ‘ইডিয়েট’ নাটকটির জন্যে তিনি দর্শক হৃদয়ে আজও এক দুর্লভ স্থান অধিকার করে আছেন।

১৯৫৮ সালে বুলবুল আহমেদের অভিনয়ের শুরুটা মঞ্চনাটক দিয়ে। সিলেটের এমসি কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষ রক্ষা’ নাটকে মূল চরিত্র ‘গদাই’ নামভূমিকায় অভিনয় করেন। মুম্বাইয়ের দিলীপ কুমার আর কলকাতার উত্তমকুমার এবং নায়িকা মধুবালা, নার্গিস ও সুচিত্রা সেন তাঁর বিশেষ পছন্দের তালিকায় আছেন।

ঢাকায় কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘শ্যামলী শিল্পী সংঘ’ নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী গঠন করেন। ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘উল্কা’ নাটকটি মঞ্চস্থ করার মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। নাটকটিতে বুলবুল আহমেদ ‘সুবীর’ চরিত্রে অভিনয় করেন। শ্যামলী শিল্পী সংঘের হয়ে পরবর্তীতে আরও যেসব নাটকে বুলবুল আহমেদ অভিনয় করেছনে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘কানাকড়ি’, ‘বারো ঘণ্টা’, ‘মানচিত্র’, ‘গোধূলির প্রেম’ ও ‘অ্যালবাম’।

বুলবুল আহমেদের স্ত্রী ফওজিয়া পারভিন ডেইজি। ছেলেবেলা থেকে দুজনে পরিচিত ছিলেন। ভালবাসা থেকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। দুই পরিবারের সম্মতিতে তাঁদের বিয়ে হয়। তদের এক ছেলে, দুই মেয়ে।

টেলিভিশনে বুলবুল আহমেদের অভিনয়জীবন শুরু হয় তাঁর নাট্যগুরু আবদুল্লাাহ ইউসুফ ইমামের হাত ধরে। অভিনেতা হিসেবে সত্যিকার অর্থে পথচলা শুরু ১৯৬৮ সালে ‘পূর্বাভাস’ নাটকের মধ্য দিয়ে। 'আরেক ফাল্গুন', 'বরফ গলা নদী', 'ইডিয়ট', 'শেষ বিকেলের মেয়ে', 'তোমাদের জন্যে ভালোবাসা', 'তুমি রবে নীরবে', 'টাকায় কি না হয়', 'মালঞ্চ', হৈমন্তী', 'এইসব দিনরাত্রি', 'সারাদিন বৃষ্টি', 'রূপনগর', 'সারাবেলা' এরকম প্রায় তিনশতাধিকেরও বেশি নাটকে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। জহির রায়হানের উপন্যাস ‘বরফ গলা নদী’-তে অভিনয় করে সবার নজরে আসেন তিনি। ‘কায়েসের’ চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করায় পরবর্তীতে জহির রায়হানের উপন্যাস নিয়ে করা সমস্ত নাটকে তিনি সুযোগ পেতে থাকেন। ‘দূরদর্শীনী' নাটকে বুলবুল আহমেদের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও সহশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের উদ্বোধনী দিনে নাটকটি প্রচারিত হয়।

বুলবুল আহমেদের নাট্যগুরু আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমামের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতেই ১৯৭৩ সালে ‘ইয়ে করে বিয়ে’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে রূপালি পর্দায় যাত্রা শুরু। মঞ্চ, রেডিও, টিভি নাটকে অভিনয়ের ক্ষেত্রে পরিবারের সকলের সহযোগিতা ও সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু চলচ্চিত্রে কাজের ব্যাপারে স্ত্রী ডেইজি বেঁকে বসেন। শ্বাশুড়ি লতিফা খানের কারণে সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। বুলবুল আহমেদ স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন, শখের বশে একটি বা দুটি ছাড়া চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন। ‘ইয়ে করে বিয়ে’করার সময় তাবাররুক নাম বদলে ‘বুলবুল’ রাখলেন পরিচালক আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম। দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘অঙ্গীকার’-এ কবরীর নায়ক হন তিনি। পাশাপাশি কার্যনির্বাহী প্রযোজক হিসেবেও কাজ করেন। দিন দিন অভিনয়ের নেশাটা বাড়তে থাকায় স্ত্রীকে দেয়া কথা আর রাখতে পারেননি বুলবুল আহমেদ। শখের অভিনয়, নেশা থেকে পেশায় পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি। ব্যাংকিং পেশা ছেড়ে দিয়ে অভিনয়ে নেমে পড়েন। সেসময় ‘জীবন নিয়ে জুয়া’ ছবির মধ্য দিয়ে ববিতার সঙ্গে জুটি বেঁধে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৭৬ সালে আলমগির কবির পরিচালিত ‘সূর্যকন্যা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জহির রায়হান পুরস্কার লাভ করেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হল- ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘মোহনা’, ‘মহানায়ক’, 'পুরস্কার', 'সোহাগ', 'বৌরানী', 'ঘর সংসার', 'বধু বিদায়', 'ছোট মা', 'আরাধনা', 'সঙ্গিনী', 'সময় কথা বলে', 'স্মৃতি তুমি বেদনা', 'শেষ উত্তর', 'স্বামী', 'ওয়াদা', 'গাংচিল', 'কলমিলতা', 'জন্ম থেকে জ্বলছি', 'দেবদাস', 'ভালো মানুষ', 'বদনাম', 'দুই জীবন', 'দিপু নাম্বার টু', 'দি ফাদার', 'রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত' প্রভৃতি।

চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন বুলবুল আহমেদ। 'অঙ্গীকার', 'জীবন নিয়ে জুয়া', 'ওয়াদা', 'ভালোমানুষ', 'মহানায়ক' সিনেমাগুলো প্রযোজনা করেন তিনি। মহানায়ক তাঁর প্রথম একক প্রযোজনা। তাঁর পরিচালিত অন্যতম প্যাকেজ নাটকগুলো হল- 'মেঘে ঢাকা আকাশ', 'তুমি কি সেই তুমি', 'একটি প্রেমের জন্য', 'মন ছুঁয়ে যায়', 'চিরকুট', 'অনামিকা', 'অন্য মনে', 'পলাতক সে', 'অকারণে অবেলায়', 'বিলেতি বিলাস', 'নীলা নামের মেয়েটি', 'তৃতীয় পক্ষ', 'একা', 'এক ঝলক আলো', 'জীবন নদীর জোয়ার ভাটা', 'ঝরা পাতা', 'মানুষজন', 'আরাধনা', 'কোন গগনের তারা', 'ঋতু গৃহ', 'বৃষ্টি', 'চলে যায় বসন্তের দিন', 'ওরা তিনজন', 'ইয়ে নিয়ে বিয়ে', 'সুভা', 'একজন পৃথিলার কথা' ইত্যাদি।

অভিনয়, প্রযোজনা এবং পরিচালনার পাশাপাশি উপস্থাপনা, বিজ্ঞাপনচিত্রে অংশগ্রহণ এমনকি বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণও করেছেন বুলবুল আহমেদ। ২০১০ সালের ১৫ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের পাশাপাশি কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।