অ্যানাকোন্ডা আর 'লাল পানি'র খোঁজে

>

অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ না হলেও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এক দেশ গায়ানা। ক্রিকেট নিয়ে লেখার পাশাপাশি গায়ানা ও গায়ানায় বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে লিখেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধি রানা আব্বাস

আবু খালেদই প্রস্তাবটা দিলেন, ‘চলুন, অ্যানাকোন্ডা দেখে আসি’। খালেদ জর্জটাউনে আছেন ছয় বছর ধরে। জর্জটাউনে বাস করলেও পুরো আমেরিকা তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। প্রতিবেশী ব্রাজিলে যাওয়া তাঁর কাছে ডাল-ভাত!
আমাজনের ভেতর দিয়ে খালেদের ব্রাজিলে যাওয়ার বর্ণনা কেমন যেন শিহরণ তোলে। গাড়ি চালাতে চালাতে ব্রাজিল, গায়ানা, সুরিনাম, পেরু, ভেনেজুয়েলা—দক্ষিণ আমেরিকার ভূগোল, সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম গরগর করে তিনি বলে যান। ২০০৩ সালের এপ্রিলে বাড়ি ছেড়েছেন, গোয়া, কলম্বো, দুবাই, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ হয়ে গায়ানায় থিতু। গত ১৫ বছরের প্রবাসজীবনে অজানা কিছুই নেই এই অঞ্চল সম্পর্কে।

আমাজনের জঙ্গল থেকে ধরে নিয়ে আসা জর্জটাউন চিড়িয়াখানার সেই অ্যানাকোন্ডা। ছবি: প্রথম আলো
আমাজনের জঙ্গল থেকে ধরে নিয়ে আসা জর্জটাউন চিড়িয়াখানার সেই অ্যানাকোন্ডা। ছবি: প্রথম আলো

তা অ্যানাকোন্ডা দেখতে পাব কোথায়? আমাজন জঙ্গলে যেতে হবে নাকি! খালেদ রহস্যের হাসি হাসেন। সেই রহস্য উদ্ঘাটন হয় মঙ্গলবার বিকেলে, জর্জটাউন চিড়িয়াখানায়। বিশাল খাঁচার ভেতর কুণ্ডলী পাকিয়ে মৃতের মতো পড়ে আছে তিনটি অ্যানাকোন্ডা। ঝিম মেরে পড়ে থাকতে দেখে দর্শনার্থীরা মৃত ভেবে আবার কোনো ঝামেলা না পাকিয়ে ফেলেন, খাঁচার গায়ে তাই নির্দেশিকা দেওয়া, ‘ইয়েস দে আর অ্যালাইভ...।’
তারা জীবিত এবং তারা ঘুমাচ্ছে। ওদের খোঁচাখুঁচি কিংবা নড়াচড়া করতে বাধ্য করা যাবে না। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে একটা অ্যানাকোন্ডা মাথাটা উঁচু করে একবার দেখল। খাঁচার ভেতর আটকা, তবুও অ্যানাকোন্ডার দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে কেমন গা ছমছম করে! জর্জটাউনের ছোট্ট চিড়িয়াখানার বড় আকর্ষণ আমাজন জঙ্গল থেকে আনা এ বিরাটকায় সর্পত্রয়ী। সেটি যখন দেখা হয়ে গেছে, এখানে থেকে আর কী লাভ!
খালেদ এবার পরের প্রস্তাবটা দিলেন, চলুন লাল পানি দেখে আসি। ‘লাল পানি’ মানে? ‘গেলেই দেখবেন’, তাঁর মুখে আবারও রহস্যের হাসি। জর্জটাউন শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে, লিনডেন সয়েসডাইক হাইওয়ের পাশে এক জলাধারের কাছে গিয়ে থামল গাড়ি। জলাধার বলতে খাঁড়ি। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এখানে আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে ওঠে গায়ানিজরা। জলধারার পাশে জঙ্গলে ফায়ার ক্যাম্পের দারুণ ব্যবস্থাও আছে। জলকেলি, পানীয়, সংগীত—গায়ানিজদের সাপ্তাহিক ছুটি কতটা আমোদে কাটে, দেখার বড় ইচ্ছে হলো।
জলাশয়ের পানির রং দূর থেকে মনে হয় কালো কুচকুচে। কাছে গেলে লালচে। এবার খালেদের কথার মর্মার্থ বোঝা গেল। ‘লাল পানি’ তাহলে এটিই। অর্থনৈতিকভাবে খুব শক্তিশালী না হলেও শুধু জনসংখ্যা কম থাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়নি লাতিন এই দেশটির। এত প্রাকৃতিক সম্পদ; সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনায় জেরবার না হলে গায়ানা থাকতে পারত উন্নত দেশের তালিকায়। খালেদই জানালেন, গায়ানায় ধনী-গরিবের বৈষম্য এতটা, যেটি বাংলাদেশকেও হার মানায়।

জর্জটাউন থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে লিনডেন সয়েসডাইক হাইওয়ের পাশের সেই জলাধার। যেটিকে ‘লাল পানি’র জলাধার বলা হচ্ছে। ছবি:প্রথম আলো
জর্জটাউন থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে লিনডেন সয়েসডাইক হাইওয়ের পাশের সেই জলাধার। যেটিকে ‘লাল পানি’র জলাধার বলা হচ্ছে। ছবি:প্রথম আলো

তবে খালেদরা এখানে খারাপ নেই। সংগ্রাম করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যদিও গায়ানায় যে ২০-২৫ জন বাংলাদেশির বাস, বেশির ভাগই এসেছেন অনিচ্ছায়। আরেক প্রবাসী বাংলাদেশি সনেট বড়ুয়া জানালেন, সবার উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্র কিংবা কানাডায় যাওয়া। বাংলাদেশ থেকে আসা বেশির ভাগ মানুষ গায়ানাকে ব্যবহার করে ট্রানজিট হিসেবে। খালেদ-সনেটরাও তাই চেয়েছিলেন। পাকেচক্রে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা আর যাওয়া হয়নি। তবে এত দিন পর তাঁদের মনে হয়, না গিয়ে ভালোই হয়েছে। এখানে তাঁরা যথেষ্ট সুখেই আছেন।
সনেটের বুকের ছাতি বড় হয়ে যায় ক্রিকেটে যখন বাংলাদেশ ভালো করে। বাংলাদেশ খারাপ করলে গায়ানায় বসবাসরত ভারতীয় ব্যবসায়ীরা নাকি তাঁদের খোঁচা দেন। প্রথম ম্যাচে জেতার পর শুধু ভারতীয়রা নয়, গায়ানিজরাও অভিনন্দন জানিয়েছেন সনেটকে। স্থানীয় মানুষেরা ‘বাংলাদেশ’ নামটার সঙ্গে এবার আরও ভালোভাবে পরিচিত হয়েছে। সনেটদের কথায় মনে হয়, ক্রিকেট শুধু একটা খেলাই নয়, এটি জড়িয়ে গেছে তাঁদের জীবনের সঙ্গেও।