জাত ব্যবসার টানে ছুটে চলেন বেদেরা

পলিথিন দিয়ে কোনোরকমে তৈরি এমন থাকার জায়গায় জীবন কাটে বেদে সম্প্রদায়ের। ময়মনসিংহের শহরতলির শিকারিকান্দা বাইপাস এলাকার এই স্থানটিই আপাতত ঠিকানা ওদের। ছবি: জগলুল পাশা
পলিথিন দিয়ে কোনোরকমে তৈরি এমন থাকার জায়গায় জীবন কাটে বেদে সম্প্রদায়ের। ময়মনসিংহের শহরতলির শিকারিকান্দা বাইপাস এলাকার এই স্থানটিই আপাতত ঠিকানা ওদের। ছবি: জগলুল পাশা

কালো প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে ছোট তাঁবুর চালে লাগানো হয়েছে সোলার প্যানেল। তা দিয়ে রাতে বাতি জ্বলে। ছোট ছোট পাখা ঘোরে। একজনের ঘরে ল্যাপটপের মতো একটি যন্ত্র (পোর্টেবল ডিভিডি প্লেয়ার)। তাতে সিডি লাগিয়ে সিনেমাও দেখা যায়। এ চিত্র একটি বেদেপল্লির।

ময়মনসিংহের শিকারীকান্দার ভাটিবাড়ারা এলাকায় প্রায় ২০টি বেদে পরিবার তাঁবু করে থাকছে দেড় মাস ধরে।
বেদে পরিবারগুলো কেমন আছে, জানতে চাইতেই একজন বললেন, ‘টাকা খরচ কইরা বাত্তির আলো পাই, কিন্তু বাচ্চাকাচ্চারে লেখাপড়া করাইতে পারি না।’
আজ সোমবার দুপুরে কথা হয় কয়েকটি বেদে পরিবারের সঙ্গে। তাঁদের দুঃখ—সাংবাদিক, বড় লোক, বিদেশিরা তাঁদের কথা শোনেন, ছবি তুলে নিয়ে যান, কিন্তু তাঁদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। যাযাবর জীবনের অবসান হয় না।

খোলা আকাশের নিচেই চলে তাদের রান্না-খাওয়া। ছবি: জগলুল পাশা
খোলা আকাশের নিচেই চলে তাদের রান্না-খাওয়া। ছবি: জগলুল পাশা

বেদেপল্লির অনেকেই ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করতে চান—চান যাযাবর জীবনের অবসান। কিন্তু জাত ব্যবসার টানে আবার তাঁরা ছুটে চলেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। এভাবেই চলছে তাঁদের জীবন। কখন ভাত আর আলু সেদ্ধ হবে, তার অপেক্ষায় বসে থাকে পরিবারের ছোট ছেলেমেয়েরা।
দেড়–দুই হাজার টাকা দিয়ে সোলার প্যানেল কিনলে তা দিয়ে কম করে হলেও পাঁচ বছর চলে বলে জানা গেল। সোলার প্যানেলের পেছনে টাকা খরচ করছেন, তাহলে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার পেছনে কেন খরচ করছেন না, এই প্রশ্নে একজনের উত্তর, সোলার প্যানেলের পেছনে একবার খরচ করলেই হয়, কিন্তু ছেলেমেয়ের পেছনে শিক্ষার জন্য খরচের তো কোনো শেষ নেই।
বেদেপল্লির সরদার ২৮ বছর বয়সী ইয়াদ আলীর চার ছেলে এক মেয়ে। তিনি জানালেন, বেদেদের সন্তানদের কারও জন্মনিবন্ধন করানো হয়নি। নিজেদেরও জন্মনিবন্ধন সনদ নেই। সন্তানদের কোনো টিকা দেওয়া হয় না। এগুলো ছাড়াই সন্তানেরা রোদ, বৃষ্টিতে ভিজে ভালোই আছে।
সাপুড়ে সুমন মিয়া জানালেন তাঁর কাছে গোখরা, চন্দ্রবুড়া, দুধরাজ, সূর্যমুখী, কালডারাইসসহ বিভিন্ন বিষধর সাপ আছে। সাপ বিক্রি এবং খেলা দেখানোই মূল ব্যবসা। বর্ষাকালে সাপের দেখা বেশি পাওয়া যায়। বনজঙ্গল থেকে সাপ ধরেন। সুমন মিয়া জানালেন, সাপের বিষদাঁত বলতে কিছু নেই। বিষের থলি আছে। কামড় দিয়ে কাত করে থলি থেকে বিষ ঢেলে দিলেই শুধু মানুষ মারা যায়।
তুরতুরী আশপাশের এলাকায় সাপ নিয়ে ভিক্ষা করেন। তবে ছোট সাপের বাক্সে সাপ থাকে না। মানুষকে ভয় দেখানোর জন্যই এ কৌশল।
মফিদুল ইসলাম ব্যথার তেল ও মাছের কাঁটাও বিক্রি করেন। ওস্তাদের কাছ থেকে এসব শিখেছেন। কারও পুকুরে সোনাদানা হারিয়ে গেলে তা–ও খুঁজে দেন তিনি।

শিশুদের এই অনাবিল হাসির মতোই রাতের বেলা সোলার প্যানেলের মাধ্যমে আলোকিত হয় ওদের ‘পলিথিনের ঘর’। ছবি: জগলুল পাশা
শিশুদের এই অনাবিল হাসির মতোই রাতের বেলা সোলার প্যানেলের মাধ্যমে আলোকিত হয় ওদের ‘পলিথিনের ঘর’। ছবি: জগলুল পাশা


ফুলজানের সন্তানসংখ্যা সাত। ছেলেসন্তানের আশায় এতগুলো সন্তান হয়েছে তাঁর। শেফালির পাঁচ সন্তান।
ফুলজান শিঙায় ফুঁ দিয়ে মানুষের দাঁত থেকে পোকা বের করেন। সাপ মাছ খায়। শালিক, দোয়েলের মাংস খায়। সাপের মুখে ধরে ধরে খাবার খাওয়ান।
কথা বলতে বলতে ঘড়ির কাঁটায় বিকেল চারটার ঘরে পৌঁছায়। তখন অনেকের ঘরে মাত্র শুরু হয় দুপুরের খাবারের আয়োজন। আয়োজন বলতে সাদা ভাত আর আলু ভর্তা।
বেদেপল্লির পুরুষদের সাফ কথা, স্ত্রীকে তাঁরা মারধর করেন। যুক্তি হলো, ঘরে দুটি হাঁড়ি বা পাতিল একসঙ্গে থাকলে একটার সঙ্গে আরেকটার ঘষা লাগবেই। একইভাবে স্বামী–স্ত্রী একসঙ্গে থাকতে গেলে একটু মারামারি হবেই। বেদে পুরুষেরা অনেক সময় ভালোবেসে ১২–১৩ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে করেন। তবে ধর্ষণ বা অন্য নির্যাতন একেবারেই নেই। কেউ কোনো অন্যায় করলে দলের সরদার যে বিচার করেন, তা–ই সবাই মেনে নেন।
বেদে পরিবারগুলো ছোট ছোট তাঁবু বানায়। আবার আরেক জায়গায় যখন যাবে, তখন সবকিছু নিজেদেরই বয়ে নিতে হবে। ফলে ছোট ছোট খুপরিতে একেকটি পরিবারের ৭ থেকে ১০ জন সদস্য থাকেন।