ক্যাম্পাসে এক বইয়ের ফেরিওয়ালা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘুরে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেন সজল কুমার দাস। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘুরে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেন সজল কুমার দাস। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বই হাতে অপেক্ষায় তিনি। কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে, কখনো অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে। হাসিমুখে পাঠকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন নতুন বই। ফেরত নিচ্ছেন পড়ে শেষ করা পুরোনোটি। কোনো জামানত নেই, চাঁদা নেই, সদস্য হতে হয় না।
তরুণের নাম সজল কুমার দাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। গত কয়েক মাসে এই অভিনব প্রচেষ্টায় তিনি তৈরি করেছেন এক শর কাছাকাছি পাঠক।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সত্যেন বোস পাঠাগারে গিয়ে দেখা মেলে সজলের। জানা হয় তাঁর গল্প।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম সজলের। বাবা মুকুল চন্দ্র দাস করেন কৃষিকাজ। মা সুমিত্রা রানী গৃহিণী। গ্রামে তাঁদের ছোট্ট একটা মুদি দোকান। এই দোকানই ছিল সজলের পড়ার ঘর। সকাল-বিকেল দোকানে বসে পড়তে হতো। সাহিত্যের বই পড়া শুরু গোবিন্দগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পর। গ্রামের বড় ভাই রাশেদ মিয়ার কাছ থেকে ‘গল্পগুচ্ছ’ নিয়ে পড়া শুরু করেন। তারপর শরৎচন্দ্র, বেগম রোকেয়া, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শওকত ওসমানসহ কয়েকজন লেখকের কিছু বই পড়া হয়। গ্রামে সাহিত্যের বইয়ের অভাব ছিল। বেশি পড়তে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সুযোগ হয় বিস্তর পড়ার। রুমমেটদের যাঁর কাছে যা বই ছিল, পড়ে ফেলতে সময় লাগেনি। পাশাপাশি হলের সত্যেন বোস পাঠাগারের সদস্য হন।
সজল শুধু নিজে পাঠক হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। চারপাশের মানুষজনকে বই পাঠে আগ্রহী করা তাঁর নেশা। একটা সময় মনে হয়, বই রুমে থাকার চেয়ে বন্ধুরা পড়লেও ভালো। তারপর থেকেই বাংলা বিভাগের কয়েকজন পরিচিত বন্ধুকে পড়ার জন্য বই দেওয়া শুরু করেন। অনেকেই বই নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বাড়তে থাকে পাঠকসংখ্যা। তখন হলের সত্যেন বোস পাঠাগার থেকে তুলে বই দিতে শুরু করেন।
সজল বললেন, ‘যাদের বই দিই, তাদের অনেকেই আগে সাহিত্যের বই পড়ত না। পছন্দের বই দেওয়ায় তারা আগ্রহী হয়।’
জগন্নাথ হলে সজলের কাছাকাছি একটি কক্ষে থাকতেন বিমল পাল নামের এক শিক্ষার্থী। বিমলের কক্ষে অনেক বই। পাঠক তৈরির অভিযানে বিমলের বইগুলো সবই ধার পেয়ে যান সজল।
শুধু আশপাশের চেনাজানা লোকজনের বই বিতরণে সীমিত থাকতে চাইলেন না সজল। মনে হলো, পাঠক বাড়াতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী যেন বই পড়ার এই উদ্যোগের কথা জানতে পারেন, সেই চেষ্টা করতে হবে। উপায় কী?

>আগে খোলা হাতে বই-খাতা নিয়ে শ্রেণিকক্ষে যেতেন সজল। কিন্তু এখন তাঁকে কাঁধে একটি ব্যাকপ্যাক ঝোলাতে হয়। কেননা সব সময় সঙ্গে বেশ কয়েকটি বই বহন করতে হয়। কোনোটা ধার দেওয়ার জন্য, কোনোটা ফেরত নেওয়া

উপায় পাওয়া গেল বাংলা বিভাগের তিন বন্ধু সাইদুর রহমান, সোহেল আকন্দ ও নাজমুল হোসেন এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর। চারজন মিলে যান ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ নামে ফেসবুক গ্রুপের অ্যাডমিনের কাছে। ক্যাম্পাসে ফেসবুকের এই গ্রুপটি বেশ জনপ্রিয়। এখানকার কর্তৃপক্ষকে রাজি করিয়ে ১৭৫টি বই ও লেখকের নামসহ ‘এডমিন পোস্ট’ দেন তাঁরা। ওই পোস্ট দেওয়ার পর ৬০-৭০ জন ছাত্রছাত্রী বই নিতে আগ্রহ দেখান।
কিন্তু একটা মধুর সমস্যা বাধে। একই বই একাধিকজন নেওয়ার আগ্রহ দেখান। কিন্তু বৈচিত্র্য রাখতে গিয়ে এক বইয়ের একাধিক কপি কেনা বা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি সজলের পক্ষে। তারপরও সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে বই দেওয়া শুরু করেন।
কাজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে সজল বলেন, ‘বই নিতে এসে সবাই অবাক হতো, আমরা শুধু ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বর নিয়েই তাদের বই দিচ্ছি। কোনো জামানত নেই, চাঁদা নেই, সদস্য হওয়া লাগে না, বই এক মাস রাখা যায়। সবাই আমাদের উৎসাহ দিয়েছে।’
কেন আপনি বই পড়ার এ উদ্যোগ নিতে গেলেন? এতে আপনার পড়াশোনার ক্ষতি হয় না? এ প্রশ্নের জবাবে সজল বললেন, ‘এখন তরুণদের মুঠোফোন আসক্তি প্রবল। চারদিকে মূল্যবোধের অবক্ষয়, সমাজের প্রতি দায়িত্বহীনতা, মাদকের ছোবল। এ অবস্থায় আমার মনে হয়, বই-ই একমাত্র সমাধান।’ তিনি বলেন, ‘যে বই পড়ে, সে কোনো অপরাধ করতে পারে না।’
আগে খোলা হাতে বইখাতা নিয়ে শ্রেণিকক্ষে যেতেন সজল। কিন্তু এখন তাঁকে কাঁধে একটি ব্যাকপ্যাক ঝোলাতে হয়। কেননা সব সময় সঙ্গে বেশ কয়েকটি বই বহন করতে হয়। কোনোটা ধার দেওয়ার জন্য, কোনোটা ফেরত নেওয়া।
এ কাজে নেমে ইতিমধ্যে বিদ্রূপ কম সইতে হয়নি। অনেকেই বলেছেন, এ ধরনের ‘পাগলামি’ ছাড়তে। বিরূপ অভিজ্ঞতাও কম হয়নি। অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করেও নির্ধারিত দিনে বই নিতে আসেননি। তারপরও নিজের কাজ করে গেছেন সজল।
সজলের কাছে এখন বই আছে ১৭৫টি। এই বইগুলো দিয়ে তিনি পাঠক তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন।
কী ধরনের বই পাঠক পড়তে চান—জানতে চাইলে সজল বলেন, শরৎচন্দ্রের বেশির ভাগ বই পাঠকের পছন্দ। ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসটির চাহিদা পান ঘনঘন। মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের মধ্যে পাঠক বেশি পড়েন শওকত ওসমানের জাহান্নাম হতে বিদায়, জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি এবং আনিসুল হকের মা।
সজল যে এক শ পাঠক তৈরি করেছেন, তাঁদের একজন পিয়া খাতুন। বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এ ছাত্রী বললেন, ‘আজকাল এ রকম কেউ করে না। ওর কাজ অনেক ভালো। আমাদের সবার উচিত, ওকে সহযোগিতা করা।’
প্রথম বর্ষ থেকে সজলের এ উদ্যোগ দেখে আসছেন স্বর্ণা আক্তার। স্বর্ণা সজলের সহপাঠী, বাংলা বিভাগেরই তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। মুঠোফোনে বললেন, ‘আগে সাহিত্যের বইয়ের প্রতি আগ্রহী ছিলাম না। ক্লাসের বই-ই বেশি পড়তাম। সজলই আমাকে সাহিত্যের ভুবনে প্রবেশ করিয়েছে।’
জগন্নাথ হলে সত্যেন বোস পাঠাগারের ইনচার্জ খোকন মোহন্ত বললেন, ‘সজল আমাদের পাঠাগারের সদস্য। পাশাপাশি তিনি নিজেও নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠক তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন। এই পাঠাগারের ৩০ জন সদস্য তাঁরই উদ্যোগে তৈরি। আমাদের পাঠাগার থেকেও যত দূর সম্ভব, তাঁকে সহায়তা করা হয়।’
সজল জানালেন, তাঁর তৈরি করা পাঠকদের মধ্যে ২৫ জন গ্রামের। বাকিরা এসেছেন ফেসবুক গ্রুপ থেকে।
বই পড়া ও পাঠক তৈরির এ উদ্যোগ সজল ছড়িয়ে দিতে চান অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও। ইতিমধ্যে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। কথা হয়েছে কারমাইকেল ও আজিজুল হক কলেজের বন্ধুদের সঙ্গেও। সজলের উদ্যোগকে ছড়িয়ে দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বন্ধুরাও।