৫ মেধাবীর বাধা পেরোনোর গল্প

৪ মার্চ অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন। শিক্ষাজীবনে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ সমাবর্তনে বিভিন্ন বিভাগের ৮০ জনকে ৯৪টি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন মেধাবী শিক্ষার্থীর গল্প শোনাচ্ছেন আসিফুর রহমান

আবু সুফিয়ান, মনিরা বেগম,আজরিন আফরিন,মেহেদী হাসান,লিমা নাসরিন
আবু সুফিয়ান, মনিরা বেগম,আজরিন আফরিন,মেহেদী হাসান,লিমা নাসরিন

ব্যাকবেঞ্চার থেকে স্বর্ণপদকজয়ী সুফিয়ান
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আবু সুফিয়ান একাই পেয়েছেন চারটি স্বর্ণপদক। এগুলো হলো—জননেতা আব্দুর রাজ্জাক স্মৃতি স্বর্ণপদক ২০১৪, অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা চৌধুরী স্বর্ণপদক ২০১৪, ড. জালাল আলমগীর স্মৃতি স্বর্ণপদক ২০১৫ ও বিচারপতি মোস্তফা কামাল স্বর্ণপদক ২০১৫। আবু সুফিয়ান কুড়িগ্রামের উলিপুর মহারানী স্বর্ণময়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়েছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের কোনোটাতেই জিপিএ-৫ ছিল না। বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে তাঁর মতোই ব্যবসায়ী হোক। কিন্তু নিজের ইচ্ছা আর মায়ের অনুপ্রেরণায় সুফিয়ান পড়ালেখায় মন দেন।

আবু সুফিয়ানের স্নাতকের ফল ৩ দশমিক ৮০, স্নাতকোত্তরে ৩ দশমিক ৮৯। তিনি বলেন, ‘স্বর্ণপদক পাওয়ার পর বাবা আমাকে বললেন, সারা জীবন যদি আর তাঁদের কিছু না দিই, তবুও কোনো আফসোস থাকবে না।’ দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই বিভিন্ন গবেষণাকাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। পড়াশোনা শেষ না হতেই দেশি-বিদেশি জার্নালে তাঁর প্রায় ৫০টি গবেষণাধর্মী লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
ছোটবেলায় সুফিয়ানের আগ্রহ ছিল আড্ডা, অভিনয় আর লেখালেখিতে। ক্লাসে ছিলেন ‘ব্যাকবেঞ্চার’। ক্লাসে পেছনের সারির ছাত্ররা ভালো ফল করতে পারেন না, অনেকে এমনটাই ভাবেন। কিন্তু সুফিয়ানের দৃষ্টিভঙ্গিটা একটু ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা অন্যরকম। এখানে আমি প্রচুর আড্ডা দিয়েছি। আড্ডার মধ্যেও শিখেছি। আড্ডা দিতে গেলে ব্যাকবেঞ্চারদের সঙ্গেই দিতে হয়। সামনের সারির অনেকে শুধু পড়াশোনা করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনাটা ২৪ ঘণ্টার। এখানে যেকোনো কিছু করতে করতেও শেখা যায়।’

অলরাউন্ডার মনিরা
ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ক্যারম, ব্যাডমিন্টন—বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে সব খেলাতেই সাফল্য পেয়েছেন মনিরা বেগম। মূকাভিনয় করেন। অবসরে বইয়ের ‘রিভিউ’ করেন।
ভাবছেন, এত সব করে পড়াশোনাটা করেন কখন? ‘আমি সময় ভাগ করে পড়ালেখা করেছি। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট পড়া শেষ করার তাড়া ছিল। যখন যা-ই করি না কেন, খেলাধুলা বা ঘোরাঘুরি করার পরও দু-এক ঘণ্টা পড়েছি। ক্লাস লেকচার টুকে নিতাম আর পরীক্ষার আগের সময়টা কাজে লাগাতাম। এভাবেই ভালো করা।’ বলেন মনিরা।
এ বছর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ সিজিপিএ নিয়ে দুটি স্বর্ণপদক পেয়েছেন মনিরা—সাংবাদিক সাহিত্যিক কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস ও রাশিদা মহিউদ্দিন মেমোরিয়াল স্বর্ণপদক।
নরসিংদীর শিবপুর থানার বংশিরদিয়ায় তাঁদের বাড়ি। বাবা প্রবাসী। মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মেয়েদের খেলাধুলা করাটা সেখানকার কেউ কখনো ভালো চোখে দেখেনি। স্কুলে মেয়েদের হ্যান্ডবল ছিল। সেখান থেকেই শুরু। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রতিদিন গ্রাম থেকে ক্লাস করতে আসতেন। কলেজের দুই বছর আর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বছর খেলাধুলায় বিরতি ছিল। কিন্তু হলে ওঠার পর থেকে আবার শুরু।
২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তহল নারী ক্রিকেট টুর্নামেন্টে পরপর দুটি ম্যাচে সেরা বোলার মনিরা। আন্তহল ক্যারমের চ্যাম্পিয়ন। ব্যাডমিন্টনের ডাবলসে রানারআপ। বিভাগের ব্যাডমিন্টন ডাবলসে চ্যাম্পিয়ন। হলের ফুটবল দল গড়ে তোলাটা তাঁর জীবনের অন্যতম অর্জন। ভলিবলে তাঁর দল আন্তহল টুর্নামেন্টে রানারআপ।
এত সব করেও টানা ভালো ফল করে গেছেন মনিরা। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে স্বর্ণপদক নেওয়ার দৃশ্যটি টেলিভিশনে সরাসরি দেখানো হচ্ছিল, যা তাঁর বাবা বিদেশে বসে দেখেছেন; আর সবাইকে ডেকে গর্ব করে বলেছেন, ‘দেখেন, আমার মেয়ে!’

ছবি: সাইফুল ইসলাম
ছবি: সাইফুল ইসলাম

আজরিনের পদক পরিবারের জন্য
আজরিন আফরিন কলা অনুষদের দুটি স্বর্ণপদক পেয়েছেন—মিসবাহউদ্দিন খান মেমোরিয়াল ও শহীদ গিয়াস উদ্দিন আহমদ স্বর্ণপদক। ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় ভালো। মুন্সিগঞ্জের এ ভি জে এম সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও সরকারি হরগঙ্গা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। উচ্চমাধ্যমিকে ঢাকা বোর্ডে মেধাতালিকায় ষষ্ঠ স্থানটি ছিল তাঁর। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় আজরিন। বড় সন্তান হওয়ায় সবার উৎসাহটা একটু বেশিই ছিল।
তবে এই প্রত্যাশা কখনো ‘চাপ’ মনে হয়নি আজরিনের কাছে। তিনি যেটা চেয়েছেন, পরিবার তাঁকে সেটাই করতে দিয়েছে। ভালো ছাত্রী ছিলেন, কেন বিজ্ঞান না পড়ে কলা পড়বেন—সেটা কখনোই বড় ইস্যু হয়নি। তাই এ দুটি স্বর্ণপদক আসলে যাঁদের প্রাপ্য, সেই মা-বাবার গলায়ই পরিয়ে দিয়েছেন তিনি। ইতিহাস বিভাগের এই কৃতী ছাত্রী এখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।

পদক নেওয়ার সময়ের একটি মজার স্মৃতির কথা বললেন আজরিন। তিনি মঞ্চে ওঠার আগে পর্যন্ত সবাই একটি করে পদক পেয়েছিলেন। তাঁকে পরানোর জন্য রাষ্ট্রপতির হাতে দুটি পদক দেওয়া হলে তিনি একটি পদক আলাদা করার চেষ্টা করছিলেন। সহকারীকে বললেন, খুলতে পারছেন না। তখন উপাচার্য পাশ থেকে বললেন, ‘এই মেয়ে দুটি পদকই পেয়েছে।’ রাষ্ট্রপতি একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘খুব ভালো, খুব ভালো।’

কলেজে ওঠার আগে লিমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জানতেন না!
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদভুক্ত কর্নেল মালেক মেমোরিয়াল স্বর্ণপদকজয়ী তিনজনের একজন কিশোরগঞ্জের লিমা নাসরিন এনি। সদর থানার বৌলাই গ্রামের সৈয়দ হাবিবুল হক উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও পৌর মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। আট ভাইবোনের সংসারে তিনি সপ্তম। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। কলেজে ওঠার আগে তিনি নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামই জানতেন না!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন দুবার। প্রথমবার প্রথম সারিতেই ছিলেন। কিন্তু ওই পরীক্ষা বাতিল হয়ে আবার পরীক্ষা নেওয়া হলে একটু পিছিয়ে যান। কিন্তু দমে যাননি। ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হয়ে নিয়ম করে পড়াশোনা শুরু করলেন। লিমা বলেন, ‘আমার পড়ার কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিল না। যখন মন চাইতো পড়তাম। আর যখন মন চাইতো না, তখন গল্প করতাম, টিভি দেখতাম।’
ঢাকায় থাকার কেউ ছিল না, পরিচিত এক ভাইয়ের মাধ্যমে প্রথম বর্ষে পড়ার সময় হলে ওঠেন। পড়াশোনার পেছনে মায়ের অবদান সব সময় স্বীকার করেন। লিমা শিক্ষকতা করতে চান। এখন একই বিভাগে এমবিএ করছেন।

আয়েশার উত্থান-পতনের শিক্ষাজীবন
জীববিজ্ঞান অনুষদের আয়েশা খাতুন মেমোরিয়াল স্বর্ণপদক পেয়েছেন মেহেদী হাসান। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৯৭ সিজিপিএ পেয়েছেন। থাকতেন ফজলুল হক মুসলিম হলে। শিক্ষাজীবনে উত্থান-পতন সব সময়ই ছিল। এসএসসি পরীক্ষায় একটু খারাপ করেছিলেন। এরপর থেকেই মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ফলাফল—উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ ৫।
ইচ্ছা ছিল মেডিকেলে পড়বেন। কিন্তু ভাগ্য তাঁকে টেনে এনেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন ভাঙার পড়ায় ঠিক মন বসছিল না। একে তো হলে খাবারের বাজে অবস্থা আর ছারপোকার কামড়, তার ওপর প্রথম বর্ষের ফলও খুব একটা ভালো হয়নি। দ্বিতীয় বর্ষ থেকে আবার নতুন করে শুরু করলেন। ক্রমান্বয়ে ভালো করতেই থাকলেন। কিন্তু প্রথম বর্ষের সেই ধকল রয়েই যায়। প্রথম-দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনোটাই হতে পারলেন না। স্নাতকোত্তরে আবারও কোমর বেঁধে নামলেন। এবার আর তাঁকে কেউ পেছনে ফেলতে পারেননি।
এরই মধ্যে মেহেদী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা নিয়ে, দেশে ফিরে আবার শিক্ষকতায় যোগ দিতে চান।