আমার বাবা পলান সরকার

আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকারের সঙ্গে মেয়ে রোকেয়া খাতুন। ছবি: প্রথম আলো
আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকারের সঙ্গে মেয়ে রোকেয়া খাতুন। ছবি: প্রথম আলো

আমার বাবা খুব সাধারণ মানুষ। তাঁর নামের আগে কোনো ডিগ্রি নেই। পদবি নেই। এই বাবাকে নিয়েই আমি গর্বিত। আমি মনে করি, আমার বাবার নামটাই একটা বিশেষণ হয়ে গেছে। রাজশাহীতে এক যুবক তাঁর একটি ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের নাম রেখেছে ‘পলান সরকার পাঠাগার’। পাঠাগারের নামকরণই হয়েছে আমার বাবার নামে। ভাবলেই ভালো লাগে। বাবা কেমন মানুষ বোঝার জন্য বাবাকে নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি।
খুব ছোটবেলায় নিজের বাবাকে হারিয়েছেন আমার বাবা পলান সরকার। তাই পঞ্চম শ্রেণির পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। কিন্তু তিনি পড়াশোনা বন্ধ করেননি। শুধু নিজে পড়াশোনা করেছেন এমন নয়, এলাকার মানুষকে বইপ্রেমী করে তোলার জন্য নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসেন। শুরুতে দেখা গেছে, দশটা বই দিলে আটটাই ফেরত পাওয়া যায় না। গ্রামের অন্য মানুষের বাড়িতে গিয়ে দেখতাম বাবার আলমারির বই। বাবাকে বলতাম। শুনে বাবা বলতেন, যার বাড়িতেই থাকুক, সে তো পড়ার জন্যই রেখেছে। পড়লেই হলো।
বইয়ের ব্যাপারে বাবার দুর্বলতা এতই বেশি যে বই কেনার টাকা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, কত লাগবে। কোনো দিন হিসাব চাননি। বিয়ের দাওয়াত খেতে উপহার হিসেবে বই নিয়ে যান। আমাদের চালকলে যাঁরা হালখাতার সময় সব টাকা পরিশোধ করতেন, বাবা তাঁদের বই উপহার দিতেন। গ্রামের স্কুলে যাদের রোল নম্বর এক থেকে দশের মধ্যে থাকত, তাদের বই উপহার দিতেন। আমাদের ভাইবোনদের লেখার জন্য রিম ধরে কাগজ কিনে দিতেন। কয়েক দিন পর পর খোঁজ নিতেন, লেখার কাগজ শেষ হয়েছে কি না। শেষ না হলে রাগ করে বলতেন, কী লেখাপড়া করো! এক রিম কাগজ শেষ হতে কয় দিন লাগে?
আমাদের পড়াশোনা করানোর ব্যাপারে বাবার প্রচণ্ডÐ আগ্রহ ছিল। এসএসসি পাস করার পর আমি চাইলাম শহরের কলেজে পড়ব। তখন আমার বড় ভাই অভিভাবক। তিনি চাইলেন, আমি গ্রামেই এইচএসসি পড়ি। আমার ইচ্ছে বুঝতে পেরে বাবা আমার পক্ষ নিলেন। ভাইয়াকে বললেন, ‘বোনকে শহরের কলেজে পড়ানোর খরচ যদি তুমি না দাও, তাহলে আমার জমি আছে, জমি বিক্রি করেই পড়াব।’
কলেজে পড়ার সময় বাইরে থাকতাম। এ সময় মেয়েদের একটা বাড়তি হাতখরচ লাগে। বাবা সেটা দিয়ে দিতেন। একসময় বড় ভাই জেনে যান, বাবা আমাকে আলাদা করে টাকা দেন। তারপর থেকে বড় ভাই ওই পরিমাণ টাকা কম দিতেন। এতে আমার অসুবিধা হয়। কিন্তু বাবা তা হতে দেননি। আমি যেদিন বাড়ি থেকে শহরে কলেজের উদ্দেশে বের হতাম, বাবা আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন। যে পথে আমি স্টেশনে যাই, সেই রাস্তায় গিয়ে টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সেখানেই টাকা দিতেন যাতে বড় ভাই বুঝতে না পারেন, আবার কষ্টও না পান।
বইয়ের দোকান ছাড়া বাবা কারও কাছে বাকিতে কোনো জিনিস কেনেন না। একবার অতিবর্ষণে জমিতে ধান হলো না। চাল কিনে খেতে হবে। একদিন বাবা বাজারে গিয়ে ব্যাগ ভরে চাল নিয়েছেন। তারপর পকেটে হাত দিয়ে দেখেন, টাকা নেই। চুরি হয়ে গেছে। বাবা ব্যাগ উপুড় করে চাল ঢেলে দিয়ে ফিরে আসছিলেন। দোকানি ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সরকার সাহেব, আপনি চাল ফেরত দিয়ে যাচ্ছেন কেন?’ বাবা বললেন, পকেটমার টাকা নিয়ে নিয়েছে। দোকানি বললেন, ‘আপনি পরের হাটে এসে টাকা দিয়েন।’ বাবা বললেন, পরের হাটে যদি আর আসতে না পারি? বাবা চাল না নিয়েই ফিরে আসেন।
বাবার বয়স প্রায় ১০০ বছর হতে যাচ্ছে। তাই বলে বাবাকে আমার কখনোই সেকেলে বলে মনে হয় না। আমি বাংলায় এমএ করেছি। মাস্টার্স শেষ করার আগেই মা আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু বাবা তাতে রাজি হননি। বাবা বলেছেন, ‘আমার মেয়ে এমএ পাস করবে। তারপর মেয়েকে জিজ্ঞেস করব, তার পছন্দের কোনো ছেলে আছে কি না। মেয়ের পছন্দের ছেলে থাকলে তার সঙ্গেই আমি তাকে বিয়ে দেব। না থাকলে আমার পছন্দের ছেলের সঙ্গে দেব।’
সত্যিই আমার পড়ালেখা শেষ হওয়ার পর বাবা আমার মতামত জানতে চাইলেন। আমি জানিয়ে দিলাম, আমার পছন্দের কোনো ছেলে নেই। বাবা শুনে বললেন, ‘তাহলে আমার পছন্দের একটি ছেলে আছে।’ তার সঙ্গেই আমাকে বিয়ে দিলেন। বিয়ে হলো, কিন্তু আমার চাকরি হলো না। বাবা বললেন, ‘সবাইকে চাকরি করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সুখী হতে বেশি কিছু লাগে না।’
বাবা খুবই উদার মানসিকতার একজন মানুষ। আমাদের একজন আত্মীয় দূর থেকে আমাদের পুকুরে গোসল করতে আসতেন। বাবা বলতেন, বাড়ির পাশে পুকুর কাটলেই হয়, এত দূরে আসার কী দরকার? আমাদের সেই আত্মীয় বাবাকে বললেন, ‘আমার বাড়ির কাছে আপনার দুই বিঘা জমি আছে, রেজিস্ট্রি করে দিলেই পুকুর কাটতে পারি।’ এ কথা শুনে সত্যি সত্যিই বাবা তাঁকে দুই বিঘা জমি রেজিস্ট্রি করে দেন। যদিও জমির বিনিময়ে কিছু টাকা তিনি দিয়েছেন, কিন্তু জমিটা তো আমাদের বিক্রি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। বাবা হাসতে হাসতে এ রকম অনেক বড় বড় কাজ করে ফেলেন।
ছোটবেলায় দেখতাম, বাবা যাত্রাপালায় অভিনয় করতেন। তখন মনে হতো, বাবা যদি টেলিভিশনে অভিনয় করতেন! আমাদের এই আক্ষেপ আর নেই। বাবা টেলিভিশনে অভিনয় করেছেন। প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে বাবাকে নিয়ে লেখা প্রতিবেদন বিভিন্ন ভাষার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
আমার বাবার বড় কোনো ডিগ্রি না থাকলেও দেশের বইপ্রেমীরা বাবাকে অনেক সম্মানিত করেছেন। বাবা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। এই বাবাকে নিয়ে আমি গর্বিত। আমার বাবা আমার অহংকার।
অনুলিখন:
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ