অবিন্তা তারিশি : লেখাপড়ায় দারুণ, বন্ধুতায় অসামান্য

>
হাসিখুশিতে উচ্ছল ১০ বন্ধু: অবিন্তা কবীর (ডান থেকে দ্বিতীয়), তারিশি জৈন (ডান থেকে চতুর্থ) এবং লেখক (বাঁ থেকে তৃতীয়)। ছবি: সংগৃহীত
হাসিখুশিতে উচ্ছল ১০ বন্ধু: অবিন্তা কবীর (ডান থেকে দ্বিতীয়), তারিশি জৈন (ডান থেকে চতুর্থ) এবং লেখক (বাঁ থেকে তৃতীয়)। ছবি: সংগৃহীত
হোলি আর্টিজান হামলার এক বছর

গত বছরের ১ জুলাই রাতে জঙ্গিরা নৃশংসতা চালায় গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে। জঙ্গিদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান দেশ–বিদেশের ২২ জন মানুষ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রাণবন্ত চার তরুণ–তরুণী: ইশরাত আখন্দ, ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবীর ও তারিশি জৈন। তাঁদের কাছের বন্ধুদের মর্মস্পর্শী স্মৃতিচারণা নিয়ে ছুটির দিনের প্রচ্ছদ

অবিন্তা কবীর আর তারিশি জৈনের সঙ্গে পরিচয় হয় ২০০৮ সালে। তখন ওরা স্কুলে পড়ে প্রাথমিক পর্যায়ে। এরপর হাইস্কুল পর্যায়ে গিয়ে আমাদের ১০ জন সহপাঠীর মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারিশি ও অবিন্তা সেরা বন্ধুর সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিল। তারা সব সময় একে অপরের সঙ্গে মজা করত। আর পরস্পরকে সহযোগিতা করার জন্য তাদের সম্পর্কটা অবিশ্বাস্য পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ওপরের ক্লাসে পড়ার সময় তারা দুজনই একই সময়ে এক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল। তখন তারা ক্রাচে ভর দিয়ে একসঙ্গে হাঁটত। তাদের বন্ধুত্ব ছিল অসামান্য। দুজনই দারুণ মানুষ এবং আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
১০ জনের যে দলের কথা বললাম, ওই দলে সবচেয়ে মজার মেয়ে ছিল তারিশি। তার হাসিটা অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিল। আমার মনে এখনো সেই ছবি ভাসে, কৌতুক বলার আগে সে কীভাবে হাসত। ওর হৃদয়টা ছিল অবিশ্বাস্য রকম দয়ায় ভরা। মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে সব সময় এগিয়ে যেত তারিশি। একজন ভারতীয় হিসেবে সে গর্ববোধ করত। নিজের শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য সে বেছে নিয়েছিল নৃত্য। স্কুলের অনুষ্ঠানে সে সব সময় অংশ নিত—নাচের মুদ্রায় সে নিজেকে মেলে ধরত। নিজের শিকড়ের কিছু অংশ সে আমাদের সঙ্গেও ভাগাভাগি করতে ভালোবাসত, মানেটা হলো আমাদের মজার মজার ভারতীয় খাবার খাওয়াত।
তারিশি ছিল খুব আবেগপ্রবণ মানুষ। অন্যের দুঃখ সহজেই তাকে ছুঁয়ে যেত। ব্যাপারটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক যে তারিশি আমাদের মাঝে আর নেই। সন্দেহ নেই, তার চেতনার কিছু অংশ আমাদের সবার মধ্যে থেকে যাবে। তার কাজকর্ম সব সময়ই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা দেবে। আর ভালোবাসা ও আনন্দ সঞ্চার করতে পারত ভালোভাবে। সে কারণে তারিশি আমাদের সবার জন্য অনুপ্ররেণার উৎস হয়ে থাকবে।
অন্যদিকে গুণপনায় অবিন্তা কবীর সব সময় আমাদের সবার ওপর প্রভাব বিস্তর করত, এমনকি হাইস্কুল পর্যন্ত ছেলেরাও ওর সঙ্গে পেরে উঠত না। তার হাসিটা ছিল চমৎকার, যা সব সময় হলরুমে শোনা যেত। খুব হালকা মেজাজের মানুষ ছিল অবিন্তা, সব সময় নিজেকে নিয়ে হাসতে পারত। বাস্কেটবল কোর্টে কিন্তু সে একেবারেই অন্য রকম—লড়াকু। বাস্কেটবল কোর্টে ও যেমন দুর্দান্ত, পড়াশোনাতেও তা-ই। পাগলের মতো খাটতে পারত। লক্ষ্য অর্জনের জন্য যা করা দরকার, তা-ই করত। সবার আগে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করত। কঠোর এই পরিশ্রমের ফসলও পেয়েছে অবিন্তা, নিজের স্বপ্নের স্কুলে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে।
অবিন্তা বাংলাদেশকে ভালোবাসত, সব সময় এই দেশকেই বাড়ি মনে করত। একটু-আধটু নয় দীর্ঘ মেয়াদে মানুষকে সাহায্য করার কথা ভাবত অবিন্তা। আবার নিজেদের বাড়ি যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন মায়ের সঙ্গে কাজ করতে ওর উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। অবিন্তার পাশে থাকলে না হেসে পারা যেত না। নিজে ভালো করেই জানত কঠোর পরিশ্রমের মূল্য আর পরিবারের গুরুত্ব।
একটি স্মৃতি মনে পড়ছে। স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্তির অনুষ্ঠানে সেরা বন্ধুদের কয়েকজনকে নিয়ে আমি মিলনায়তনে ঢোকার আগে একটি টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে ছিল আনন্দের অনুভূতি আর উত্তেজনা। অন্যদিকে উদ্বেগও ছিল। তাই আমরা পরস্পরকে ভরসা দিচ্ছিলাম। আমরা বললাম, স্নাতকের পর সব নতুন অভিজ্ঞতা হবে। নতুন জীবন একত্রে শুরু করব আমরা। এ নিয়ে আমরা উত্তেজিত। আর যা-ই ঘটুক না কেন, আমাদের ভালোবাসা অটুট থাকবে। সেই ভালোবাসা মাত্র এক বছর স্থায়ী হয়েছিল, ব্যাপারটা বেদনাদায়ক। কিন্তু সেই মুহূর্তে যে ভালোবাসা অনুভব করেছি, তার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।
১ জুলাই বাংলাদেশকে কালো ছায়ায় ঢেকে দিয়েছে। শুধু আমরা যারা তারিশি, অবিন্তা ও ফারাজকে চিনতাম তাদের হৃদয়ে নয়, যঁারা তঁাদের চিনতেন না—এই ঘটনা তঁাদের জীবনেও শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। এই বেদনাদায়ক ঘটনার ব্যাপ্তি এতটাই, এটি ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশের হৃদয় কাঁপিয়ে দিয়েছে। তাদের পরিচিতজন ও পরিবারের সদস্যদের জন্য গত বছরটা কঠিনের চেয়ে বেশি কিছু ছিল।
আজ এক বছর পর এই চমৎকার মানুষদের সম্মানিত করার জন্য যা যা করা যায়, আমরা তার চেষ্টা করছি। আমাদের স্মৃতিতে তাদের জাগিয়ে রাখার জন্যই এত চেষ্টা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
লেখক: শিক্ষার্থী, কর্নেল ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র