নারী ঘরেই বেশি নির্যাতিত

নারী নির্যাতন নিয়ে সরকারের প্রথম জরিপ
নারী নির্যাতন নিয়ে সরকারের প্রথম জরিপ

সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর অগ্রগতি বড় ভূমিকা রাখলেও ঘরের মধ্যে নারীর অবস্থা তেমন বদলায়নি। দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময়ে, কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেছেন, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক এবং ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বিস্ময়কর আরও তথ্য হচ্ছে, এসব নারীর ৭৭ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা বিগত এক বছরেও একই ধরনের নির্যাতন ভোগ করেছেন। বড় অংশের নারীকেই তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক গড়তে বাধ্য হতে হয়েছে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশে প্রথমবারের মতো নারী নির্যাতন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি জরিপ চালিয়েছে। ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১১’ নামের এই জরিপে নারী নির্যাতনের এ ধরনের চিত্রই উঠে এসেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এর আগে দেশে নারী নির্যাতন নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা আলাদাভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিবিএসের এ জরিপ বলেছে, শারীরিক নির্যাতনের শিকার নারীদের মাত্র অর্ধেক চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পান। এক-তৃতীয়াংশ নারীই স্বামীর ভয়ে বা স্বামী সম্মতি না দেওয়ায় চিকিৎসকের কাছ পর্যন্ত যেতেই পারেননি।
আন্তর্জাতিক সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান সালমা খান প্রথম আলোকে বলেন, পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে আগে নারীরা মুখ খুলতেন না। ঘরোয়া ব্যাপার বা লজ্জাজনক মনে করতেন। বর্তমানে মুখ খুলছেন। অন্যদিকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহুদিন আগে থেকেই কাজ হচ্ছে। কিন্তু নারী নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছেই। এর মূল কারণ হলো, নারী নির্যাতনের বিষয়টি এখনো জাতীয় বিষয়ে পরিণত হতে পারেনি। চোখের সামনে নির্যাতন দেখলেও সবাই মেনে নিচ্ছে। দুর্বল আইনের শাসনও এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। তাই এ ধরনের সংস্কৃতি যত দিন পরিবর্তন না হবে, তত দিন নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
জরিপ: জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় সরকার এ জরিপ করেছে। এ জরিপ প্রকল্পের পরিচালক জাহিদুল হক সরদার প্রথম আলোকে বলেন, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সদস্যরাষ্ট্রগুলোতে নারী নির্যাতনের অবস্থান জানার জন্য জাতিসংঘের পরিসংখ্যান বিভাগের (ইউএনএসডি) নির্ধারিত মানদণ্ডের আলোকে জরিপ চালানোর আহ্বান জানানো হলে ভিয়েতনামের পরেই বাংলাদেশ এ ধরনের জরিপ চালিয়েছে। নির্ধারিত মানদণ্ডে বিবাহিত নারীদের যৌন নির্যাতনের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে কিছু কিছু বিষয়, যেগুলো দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়, তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
ভিয়েতনামের পরিস্থিতি অবশ্য বাংলাদেশের তুলনায় খানিকটা ভালো। ভিয়েতনামের করা জরিপ অনুযায়ী, সে দেশের ৫৮ শতাংশ নারীই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন। অন্যদিকে, উন্নত বিশ্বের নারীরাও পারিবারিক নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। ২০১০ সালের ইউরোপীয় ইউনিয়নের করা এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, ইউরোপের প্রতি চারজন নারীর মধ্যে একজন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন। জরিপে বলা হয়েছে, ৭৮ শতাংশই মনে করেন, নারী নির্যাতন খুবই পরিচিত ঘটনা।
অন্য একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইসরায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ নারী তাঁদের স্বামী বা ছেলেবন্ধুর হাতে খুন হন।
ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০১১ সালে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বছরটিতে ৪৪ শতাংশ নারী স্বামী বা আত্মীয়স্বজনের মধ্যমে নির্যাতনের শিকার হন।
বিবিএস এ জরিপের জন্য সাতটি বিভাগের সাতটি গ্রাম ও সাতটি শহরকে বেছে নেয়। তারপর গ্রাম ও শহর মিলে ৪২০টি এলাকায় ভাগ করা হয়। একেকটি এলাকায় ৩০টি খানা থেকে একজন করে নারীকে বাছাই করা হয়। ১৫ বছরের বেশি বয়সী ১২ হাজার ৬০০ জন নারীকে লটারির মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়। তাঁদের মধ্যে ১২ হাজার ৫৩০ জন নারী জরিপে তথ্য দেন। জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয় ২০১১ সালের ১৯ থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আর গত ৩০ ডিসেম্বর জরিপটি প্রকাশ করা হয়েছে।
জরিপ অনুযায়ী, শহরের তুলনায় গ্রামে নারী নির্যাতনের ঘটনা একটু বেশি ঘটে। বয়স অনুযায়ী নির্যাতনের ধরন পাল্টাতে থাকে। আবার যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে অবিবাহিত নারীরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিবাহিত নারীরা এর শিকার বেশি হন। মূলত স্বামীর বাড়িতে নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার বেশি হন। জরিপে ৭ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, নির্যাতনের কারণে তাঁরা আত্মহত্যা করার চেষ্টা চালিয়েছেন। বিবাহিত নারীদের ৫৬ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়সের আগেই।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি প্রথম আলোকে বলেন, নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিতে তিনি একমত নন। আগে নির্যাতনগুলো প্রকাশিত হতো না, এখন প্রকাশিত হচ্ছে। তবে নির্যাতনের ধরনে পরিবর্তন এসেছে।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, সরকার নারী নির্যাতন প্রতিরোধের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে কাজ চলছে। এ ক্ষেত্রে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা বাড়াতে হবে, যাতে করে নারীর আত্মসম্মান বাড়ে এবং নিজের অধিকারটা বুঝতে পারে। তবে সবার আগে প্রয়োজন সমাজের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
স্বামীর মাধ্যমে যৌন নির্যাতন: জরিপে চার ধরনের নির্যাতনের কথা বলা হয়েছে। যেমন: শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে ৪৫ শতাংশ নারীকে তাঁদের স্বামীরা চড় বা ঘুষি মেরে আহত করেছেন, আর ১৫ শতাংশ লাথি বা মারধরের শিকার হয়েছেন। যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ নারী ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর সঙ্গে শারীরিক মিলনের সময় আহত হয়েছেন। আর ৩০ শতাংশ স্বামীর ভয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শারীরিক মিলনে বাধ্য হন।
জরিপ বলছে, এক-চতুর্থাংশ নারীর ক্ষেত্রেই এ ধরনের যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বিগত এক বছরে। ২০ থেকে ৩৪ বছর বয়সী নারীরা এ নির্যাতনের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছেন। শহরের তুলনায় গ্রামে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। জরিপে প্রত্যেকের কাছে ঠিক এক বছর আগে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন কি না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছিল। তাতে দেখা যাচ্ছে, নির্যাতনের পরিমাণ তেমন কমেনি।
ধারণা করা হয়, ঘরের ভেতরে নারীরা নিরাপদ। তবে এ জরিপ বলছে উল্টো কথা। বাইরের মতো ঘরের ভেতরেও স্বামী ও অন্যান্য আপনজনের কাছেই নারী ঝুঁকির মধ্যে থাকেন এবং নির্যাতনের সম্মুখীন হন।
বিয়ের আগের চিত্রটিও নারীর জন্য ভয়াবহ। প্রায় ৪২ শতাংশ নারী বলছেন, তাঁরা ১৪ বছর বয়সের আগেই জোরপূর্বক যৌনসম্পর্ক করতে বাধ্য হন, আর ৩৫ শতাংশ নারীর প্রথম এ অভিজ্ঞতা হয় ১৯ বছর বয়সে পা দেওয়ার আগেই।
জরিপটি বলছে, জীবনের কোনো না কোনো সময়ে ৬৫ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামীর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। আর বিগত এক বছরেই এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বিবাহিত নারীদের প্রায় অর্ধেক। সে সময়ে ২০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী নারীরা বেশি নির্যাতনের শিকার হন। একাধিক বিয়ে করা ৯৮ শতাংশই বলছেন, সাবেক স্বামীও তাঁদের মারধর করতেন। এর মধ্যে আবার ৬৬ শতাংশই বর্তমান স্বামীর হাতে একইভাবে নির্যাতনের শিকার।
জরিপ অনুযায়ী, বিবাহিত নারীদের প্রায় অর্ধেকই অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হন। এক-তৃতীয়াংশই গত এক বছরে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ নির্যাতনও গ্রামে একটু বেশি দেখা যায়। ৩০ শতাংশ নারী বলেছেন, স্বামীরা হাতখরচ দিতে অস্বীকৃতি জানান। ১৭ শতাংশ বলেছেন, স্বামীর টাকাপয়সা আছে এবং অন্যান্য খাতে খরচও করছেন, কিন্তু তার পরও তাঁরা সংসারের খরচ দিতে চান না।
অন্য সদস্যদের মাধ্যমে নির্যাতন: শেষ এক বছরে স্বামী ছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নারী নির্যাতনের শিকার হন। ২৯ বছরের কম বয়সী নারীরা এ ধরনের নির্যাতনের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। ৪ শতাংশ নারী পরিবারের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। গড়ে ৪২ শতাংশ নারী এবং ৫০ শতাংশ শহরের নারী ১৪ বছর বয়সের আগেই যৌনসম্পর্ক করতে বাধ্য হন। এক-তৃতীয়াংশই বলেছেন, তাঁদের প্রথম এ অভিজ্ঞতা হয় ১৯ বছর বয়সে পা দেওয়ার আগেই।
আরও কিছু তথ্য: দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছে এমন ১৯ শতাংশ নারী বলেছেন, বর্তমান স্বামীর ঘরে থেকে তাঁরা নিজেদের পছন্দে ভোট দিতে পারেন না। আগের স্বামীর সংসারে একই অবস্থা ছিল ২০ শতাংশ নারীর। নির্যাতনের ঘটনাস্থল নিয়েও জরিপে রয়েছে কিছু চমকপ্রদ তথ্য। যেমন: প্রায় ৮৮ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা স্বামীর সংসারে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, ৮৬ শতাংশ হন মানসিক নির্যাতনের শিকার আর যৌন নির্যাতনের শিকার হন ৫৫ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে কর্মক্ষেত্র। ১৬ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতন, ২৬ শতাংশ মানসিক নির্যাতন আর ২৯ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হন। অর্থাৎ, ঘরে বা বাইরে কোথাও নিরাপদ নন নারীরা।