ময়মনসিংহের আলো

বোনের মতো বন্ধু তারা। ছবি: জাহিদুল ইসলাম
বোনের মতো বন্ধু তারা। ছবি: জাহিদুল ইসলাম

‘কিমা পুরি!’বলতে গিয়ে তাসনিম বারীর চোখমুখ ঝলমল করে উঠল।

ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ ঘুরে দেখতে গিয়েছিলাম মাস দেড়েক আগে। সেখানেই দেখা তাঁর সঙ্গে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি থেকে এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন তিনি। জানতে চেয়েছিলাম, কলেজের কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি মিস করবেন? তখন এল কিমা পুরির প্রসঙ্গ। তাসনিম হেসে বলছিলেন, ‘বন্ধু আর শিক্ষকদের সঙ্গে আশা করি যোগাযোগ থাকবে। কিন্তু প্রতিদিন যে ক্যানটিনের কিমা পুরি খেতে পারব না, এটা একটা দুঃখের ব্যাপার।’ জানালেন, মেডিকেলে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। উচ্চমাধ্যমিকের সনদ আর টুকটাক কিছু কাগজ তুলতে এসেছিলেন নিজের ‘পুরোনো’ ক্যাম্পাসে।

ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজটি যে বহু পুরোনো, এ তথ্য আমরা কলেজের মূল ফটকে পা রেখেই পেয়েছি। নামফলকের নিচে লেখা আছে, ‘স্থাপিত: ১৯৫৯’। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বয়স ৫৮ বছর পেরিয়েছে, সেটা দেখে বোঝার উপায় নেই। শিক্ষার্থীদের উচ্ছল মুখগুলোই বোধ হয় ক্যাম্পাসটাকে ‘তরুণ’ করে রেখেছে।

উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে এখানে পড়ছেন প্রায় ৮ হাজার ছাত্রী। স্থানীয়রা তো বটেই, আশপাশের এলাকা থেকেও অনেকে পড়তে আসেন ময়মনসিংহ শহরে অবস্থিত এই মহিলা কলেজে। তাসনিমা আফরোজ যেমন এসেছেন শেরপুর থেকে। পড়ছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষে। তাসনিমার আরেকটা পরিচয় হলো, তিনি মুমিনুন্নিসা কলেজের ভলিবল দলের অধিনায়ক। নতুনদের খেলা শেখানোর দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। তাসনিমার নেতৃত্বে এরই মধ্যে বেশ কিছু পুরস্কার যোগ হয়েছে কলেজের শোকেসে। স্নাতক তো প্রায় শেষ, শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পরও কি খেলাধুলা চালিয়ে যাবেন? প্রশ্ন শুনে তাসনিমা একটু ভাবনায় পড়ে গেলেন। বললেন, ‘না বোধ হয়। পড়ালেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার খেলাধুলাও শেষ। এরপর বিসিএসের জন্য চেষ্টা করব।’

তাসনিমার দেখানো পথে ভলিবল খেলায় নাম লিখিয়েছেন, এমন আরেকজনের সঙ্গে কথা হলো। গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ফারহানা বেবি। শুরুতে নাকি কলেজ তাঁর ভালো লাগত না। এখন লাগে। কেন? ‘আমাদের এখানে সারা বছর কোনো না কোনো অনুষ্ঠান, খেলাধুলা চলতেই থাকে। বোরিং লাগার কোনো সুযোগ নেই।’ বললেন তিনি। ফারহানা কলেজের হোস্টেলে থাকেন। তাই দিন-রাত ক্যাম্পাসের আমেজটা উপভোগ করেন তিনি।

শিক্ষার্থীদের অর্জিত পুরস্কারগুলোর সামনে গর্বিত অধ্যক্ষ
শিক্ষার্থীদের অর্জিত পুরস্কারগুলোর সামনে গর্বিত অধ্যক্ষ

হোস্টেলে শিক্ষার্থীরা একেক রুমে ৮ জন করে থাকেন। খাবার খুব একটা ভালো না। তবুও হোস্টেল জীবনটা তাঁদের ভীষণ প্রিয়। ‘আমরা সবাই বোনের মতো। রাতে যখন রুমমেটরা একসাথে হই, সারা রাত কত যে গল্প হয়!’ এ তথ্য দিলেন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মার্জিয়া খান। তিনিও নাচ, গান, খেলাধুলাসহ নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন। একবার নাকি কলেজের নৃত্যনাট্যে ‘নায়ক’ সেজে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। বলছিলেন, ‘ছেলে সাজার পর মঞ্চে আমাকে দেখে অনেকে চিনতে পারেনি।’

একই অভিজ্ঞতা আছে জান্নাতুন নাহারেরও। মৈমনসিংহ গীতিকায় তিনি ‘নদের চাঁদ’ সেজেছিলেন। মঞ্চে তাঁকে দেখে কেউ চিনতে পারেনি। নাম ঘোষণার পর সবাই আঁতকে উঠে বলেছে, ‘আরে! এ তো আমাদের নূপুর আপু!’ হ্যাঁ, নূপুর নামেই জান্নাতুন নাহারকে চেনে পুরো ক্যাম্পাস। নাচ, গান, আবৃত্তি, উপস্থাপনা, অভিনয়—সবকিছুতে তিনি আছেন। ক্যাম্পাসের বাইরেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কলেজের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি।

আমরা যখন নূপুর, তাসনিমা, ফারহানা, মার্জিয়াদের সঙ্গে কথা বলছি, এর মধ্যে ঘুরেফিরে আবার এলেন তাসনিম বারী। এবার তাঁর হাতে একটা ঠোঙা। এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নেন। কিমা পুরি শেষ হয়ে গেছে। সমুচা খান।’ মনে হলো কলেজ ক্যানটিনের ‘বিখ্যাত’ কিমা পুরি খাওয়ানো হলো না বলে বেচারির খুব মন খারাপ।

মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ ঘুরে এসেছি সেপ্টেম্বর মাসে। এর মধ্যে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা শেষ হয়ে ফলাফলও বেরিয়ে গেছে। তাসনিম বারীর মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন কি পূরণ হয়েছে? জানতে প্রথম আলোর ময়মনসিংহ প্রতিনিধি কামরান পারভেজকে ফোন করলাম। খোঁজ নিয়ে তিনি জানালেন, ‘হ্যাঁ, তাসনিম দিনাজপুর মেডিকেলে চান্স পেয়েছেন।’

প্রতিবছরই তাসনিমের মতো বহু শিক্ষার্থী মুমিনুন্নিসা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেলসহ বিভিন্ন নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হচ্ছেন। কলেজের অধ্যক্ষ মো. মোজাহার হোসেন বলছিলেন, ‘একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল বেরোলেই দল বেঁধে শিক্ষার্থীরা দেখা করতে আসে। কেউ বলে, “স্যার, আমি বুয়েটে চান্স পেয়েছি;” কেউ বলে, “স্যার, আমি মেডিকেলে চান্স পেয়েছি...।” শুনে আমার মন ভরে যায়।’

বাইরে-ভেতরে সব ক্ষেত্রেই মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা নেই। পড়ালেখার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে মেয়েরা সমানতালে অংশ নিচ্ছে। শিক্ষার একটা ভালো পরিবেশ আছে। উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক, স্নাতকোত্তর—সব পর্যায়েই আমাদের মেয়েদের পরীক্ষার ফল বেশ ভালো।

মো. মোজাহার হোসেন

অধ্যক্ষ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ