পিএইচডি করতে যাচ্ছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সুরাইয়া

সুরাইয়া আকতার
সুরাইয়া আকতার

সুরাইয়া আকতারের চোখের সামনে সবকিছু ধূসর থেকে গাঢ় ধীরে ধীরে অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁর চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সুরাইয়া যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে, পিএইচডি করতে। তাঁর পিএইচডির বিষয় প্রতিবন্ধিতা ও নারী। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধিতা ও কর্মসংস্থান বিষয়ে পিএইচডি করতে গেছেন তাঁর স্বামী মিজানুর রহমান। তাঁদের সঙ্গে যাচ্ছে ৪ বছর ৩ মাস বয়সী ছেলে শেহরান সানিম রহমান। এই পরিবার ২৭ জুলাই রাতে রওনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে।

২৬ জুলাই ঢাকার বাসায় বসে কথাগুলো জানানোর সময় সুরাইয়ার চোখেমুখে ছিল খুশির ঝিলিক। এক দিন পরেই তাঁদের ফ্লাইট। তাই ব্যস্ততার অন্ত নেই। কথার ফাঁকেই সুরাইয়া খিচুড়ি ও গরুর মাংস রান্না করলেন।

প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন তাঁর স্বামী মিজানুর রহমান। ২০০৮ সালে গড়ে তোলেন ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (পিডিএফ) নামের একটি সংগঠন। এ সংগঠনের অন্যতম প্রধান কাজ সমাজের স্বাভাবিক মানুষদের প্রতিবন্ধী মানুষ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিডিএফের কমিটি কাজ করছে। শিক্ষার্থীরা এসব কমিটি পরিচালনা করছেন। আর মিজানুর রহমান ছিলেন এ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট। এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সংগঠনের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

সুরাইয়ার জীবনের গল্পটা অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা। ২০১৫ সালে সুরাইয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। তিনি ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী। সেই সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল মিজানুর রহমানের সঙ্গে। মিজানুরও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে পড়াশোনা করেছেন। পরিবার ও সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে ২০১২ সালে তিনি সুরাইয়াকে বিয়ে করেন। এখন দুজন মিলে প্রতিবন্ধিতা নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরবেন—এমনই ইচ্ছা।

নীলফামারীর মেয়ে সুরাইয়া। তিনি জন্মগতভাবে রেটিনার সমস্যায় আক্রান্ত। এইচএসসি পর্যন্ত নিজে লিখেই পরীক্ষা দিতে পেরেছেন। কিন্তু তারপর থেকে চোখের সামনে সবকিছু ধূসর হতে থাকে। বর্তমানে সূর্যের আলোতে সামনের জিনিস কিছুটা দেখলেও ঘরের ভেতরে আবছা ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখেন না। চার বোনের মধ্যে তাঁর ছোট বোনেরও একই সমস্যা।

সুরাইয়া আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘মাত্র দুই বছর আগে ভারতে গিয়ে জানতে পারি, আমার চোখের সমস্যাটা জিনগত। তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সন্তান জন্ম নেওয়ার আগেই বিষয়টি জানা গেলে ভালো হতো। কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেত। এখন ছয় বছর বয়স পর্যন্ত সন্তান ঝুঁকির মধ্যে থাকবে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।’

অস্ত্রোপচার করে সন্তান জন্ম দেওয়ার ফলে চোখের অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে চলে যায়। স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে বিয়ে, শেষ বর্ষের পরীক্ষার সময় সন্তানের জন্ম। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী হিসেবে সুরাইয়াকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। এক শিক্ষক তো সরাসরিই বলে দিয়েছিলেন, যেহেতু চোখে দেখে না, তাই পড়াশোনার দরকারটা কী। এ সময় বিভিন্নভাবে পাশে দাঁড়ায় পিডিএফ।

সুরাইয়া বলেন, ‘আমি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলেও আমার পরে যে শিক্ষার্থীরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছেন, তাঁদের এ পথ পাড়ি দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে।’ চোখের সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হলেও সুরাইয়া ঠিকই সামলে চলছেন সংসার ও সন্তান পালনের দায়িত্ব। রান্নাঘরের সব জিনিস ঠিক জায়গায় থাকলে অনুমান করেই রান্না করেন। পাশ থেকে স্বামী মিজানুর জানালেন, এমনকি ইউটিউব থেকে নতুন নতুন রান্নার রেসিপি অনুযায়ী রান্নাও চলে পুরোদমে। সবকিছুতে স্বামীর সহযোগিতার হাত যে আছে, তা তাঁদের কথোপকথনেই বোঝা যাচ্ছিল।

শুধু সংসার নয়, দেশে সুরাইয়া উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বামী ও স্ত্রী দেশে ফিরে প্রতিবন্ধিতা বিষয়টি নিয়ে নতুন করে কাজ করবেন বলে জানালেন। তাঁদের স্বপ্নের সংগঠন পিডিএফকে একটি ইনস্টিটিউট হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্নের কথাও জানালেন তাঁরা।