বৈচিত্র্যই শক্তি

জাস্টিন ট্রুডো
জাস্টিন ট্রুডো

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির (এনওয়াইইউ) যে বিষয়টি আমার সবচেয়ে পছন্দ তা হলো, এখানকার ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভিনদেশ থেকে এসেছে। পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে কলেজের গণ্ডিতে পা রেখেছে, এমন শিক্ষার্থীর হারও নিশ্চয় একই রকম। একটা দলে যতটা বৈচিত্র্য থাকা সম্ভব, তার সবই এখানে আছে।

১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে আমি যখন স্নাতক হলাম, তখন চমৎকার একদল বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। বিস্ময়করভাবে সেই বন্ধুরা এখনো আমার খুব আপনজন। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার নানা প্রান্তে আমরা বেড়িয়েছি, পাহাড় চড়েছি। এটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা। সে এক দারুণ রোমাঞ্চ! আমার জ্ঞানে, শিক্ষায় এই ভ্রমণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। কারণ এই প্রথম আমাকে নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়েছে, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা, রীতিনীতি, ভাষা, মূল্যবোধের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছে। কানাডার মন্ট্রিয়েলের এক তরুণের যখন মৌরিতানিয়ায় বসবাসরত একজন কোরীয় জেলের সঙ্গে দেখা হয়, আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে আসা এক রাশিয়ান সৈনিক কিংবা ডানাংয়ের এক দোকানদারের সঙ্গে পরিচয় হয়, অবধারিতভাবেই আড্ডাটা জমে ওঠে। অনেক অজানাকে জানা হয়।

তোমাদের মধ্যে অনেকেও নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষে একটা ভ্রমণে বেরোনোর পরিকল্পনা করছ। জানি কেউ কেউ তোমাদের বলবে, ‘আজকালকার দিনে, এই বয়সে এমন একটা ভ্রমণে বেরোনো ঠিক হবে না। এটা নিরাপদ নয়!’ আমার প্রশ্ন হলো, আমাদের এই শুভাকাঙ্ক্ষীরা কি শুধু আমাদের শারীরিক নিরাপত্তা নিয়েই দুশ্চিন্তিত? নাকি তাঁরা ভাবেন, নিজের গণ্ডি থেকে বেরোলে আমরা হয়তো একটা নতুন পৃথিবী দেখব, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মিশে হয়তো আমার বিশ্বাস আর মূল্যবোধগুলো বদলে যাবে, আমি হয়তো একটা অন্য মানুষ হয়ে ফিরে আসব! হয়তো এই ভয়েই তাঁরা আমাদের আগলে রাখতে চান।

১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি যখন বেরিয়েছিলাম, তখনকার পৃথিবীও কিন্তু কম জটিলতাপূর্ণ ছিল না। সমস্যা ছিল, আছে, ভবিষ্যতেও আসবে। যদি আমরা নিজস্ব গণ্ডির ভেতরে বন্দী হয়ে থাকি, তাহলে কখনোই পরস্পরকে সম্মান করতে শিখব না, সবাই মিলে একটা সমস্যার সমাধান করতে পারব না। নেতিবাচকতার প্রতি আমাদের একটা অদ্ভুত মোহ আছে। সিনেমা, টিভি, সব জায়গায় তুমি এই ব্যাপারটা দেখবে। অথচ সমস্যা আর সম্ভাবনা কিন্তু সব সময় ভারসাম্য রেখে চলে। চরম দারিদ্র্য আমরা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারি, ম্যালেরিয়া বা টিবির নাম মুছে ফেলতে পারি, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে পারি। এটা করতে হলে আমাদের সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে হবে। আমাদের সংকীর্ণ মানসিকতার সঙ্গে লড়াই করতে হবে মানবতা দিয়ে।

আমরা একই গির্জায় যাই? দারুণ, তুমি আমার গোষ্ঠীর। তুমি আমার ভাষায় কথা বলো? তাহলে তুমি আমার দলে। তুমি এনওয়াইইউতে পড়েছ? তুমি আমাদের একজন। তুমি পোকেমন গো খেলো? তাহলে তুমি আমার দলে। সব জায়গায় শুধু দল, জাতি, গোষ্ঠী। কাউকে দলভুক্ত করা সমস্যা নয়, সমস্যা হলো বাকিদের দলের বাইরে বের করে দেওয়া। তুমি আমাদের একজন, কিন্তু ও নয়!

বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম, বিশ্বাস কিংবা মূল্যবোধের বৈচিত্র্য আমাদের দুর্বলতা হতে পারে না। বরং এটাই তো সবচেয়ে বড় শক্তি।

অতএব তোমাদের প্রতি আমার অনুরোধ, এখান থেকে বেরিয়ে তোমরা এমন একটা জায়গায় যাও, যেখানকার মানুষের বিশ্বাস বা মূল্যবোধ তোমার চেয়ে আলাদা। তাঁদের কথা মন দিয়ে শোনো, বুঝতে চেষ্টা করো। খুঁজে বের করো, তোমার সঙ্গে তাঁর মিলটা কোথায়। আঙুলের ছোঁয়ায় তুমি সারা পৃথিবী দেখতে পারো। কিন্তু তুমি যদি পৃথিবীর অন্য একটা প্রান্তে যাও, দেখবে একটা পুরো অন্য জগৎ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রতি পদে পদে তোমার কোনো না কোনো ‘শিক্ষকের’ সঙ্গে দেখা হবে আর তুমি নতুন কিছু শিখবে। এই শিক্ষাকে সাদরে গ্রহণ করো। তুমি একজন ছাত্র। আজীবন ছাত্রই থাকবে। কিন্তু এখন তোমার নেতৃত্ব দেওয়ার সময়।

প্রতিটি প্রজন্মেই একজন নেতার জন্ম হয় কখন জানো? যখন একজন বুঝতে পারে, সমস্যা সমাধানের দায়িত্বটা অন্য কারও নয়, নিজের। এখন এই উপলব্ধির সময় তোমাদের।
অভিনন্দন ২০১৮-এর ক্লাস। যাও, পৃথিবী বদলে দাও! (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ
সূত্র: টাইম ডট কম