নিশ্চয়তা ও অনিশ্চয়তার জীবন

>বিশ্বের অন্যতম সেরা টেনিস খেলোয়াড় মারিয়া শারাপোভা। এখন তাঁর ক্যারিয়ার খানিকটা ম্লান হলেও, একসময় তিনিই তো র‍্যাঙ্কিংয়ে ১ নম্বর ছিলেন। ২০১৬ সালে ডোপ টেস্টে ধরা পড়ার ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন এই রুশ তারকা। খোলা চোখে দর্শক কেবল খেলাটাই দেখে। কিন্তু ১৫ মাস কোর্টের বাইরে থাকার পর একজন টেনিস খেলোয়াড় যখন আবার ফেরেন, কী চলে তাঁর মনের ভেতর। পড়ুন দ্য প্লেয়ারস ট্রিবিউনে প্রকাশিত মারিয়া শারাপোভার লেখায়
মারিয়া শারাপোভা
মারিয়া শারাপোভা

নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার পর প্রথম ম্যাচ খেলতে নামার আগে সবাই আমাকে শুধু একটা প্রশ্নই করছিল—কেমন লাগছে আমার। বন্ধু, স্বজন, এমনকি সাংবাদিক, সবার একই জিজ্ঞাসা। ‘মারিয়া, এত দিন পর কোর্টে নামতে তোমার কেমন লাগবে?’ আমার উত্তর সব সময় একই ছিল, ‘আমি জানি না।’

সত্যি...ভাবতে পারছিলাম না। কী অনুভূতি হবে আমার? নার্ভাস? রোমাঞ্চিত? আত্মবিশ্বাসী? আনন্দিত? সতর্ক? দুঃখিত? ভীত? ভালোবাসায় পূর্ণ? একদিকে প্রশ্নটা খুব সহজ। নিজের সম্ভাব্য অনুভূতিটা চট করে বলে ফেলা, এ আর এমনকি। কিন্তু অন্যদিকে, এই অনুভূতি তো আমার একেবারেই অজানা। যেন পৃথিবীর সব অনুভূতি আমার ভেতর এসে ভর করবে, যখন ১৫ মাস পর আমি স্টুটগার্টে খেলতে নামব।

মনে মনে আমি সব অনুভূতির জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এটাই তো আমার কাজ। প্রতিটা ম্যাচের জন্য, সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। কিন্তু দ্রুতই বুঝতে পারলাম, আমার সব প্রস্তুতিই বৃথা। যা আসছে, তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার কোনো উপায় নেই। আমি অনুমান করতে পারি, কল্পনা করতে পারি, মন-স্পটে প্রতিটি দৃশ্যের ছবি আঁকতে পারি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য হলো—কী হবে, তা আমি জানি না। বুঝতে পারছিলাম, আমার সামনে একটাই পথ খোলা আছে। কোর্টে নামা এবং লম্বা একটা দম নিয়ে খেলা শুরু করা।

অনিশ্চয়তার সঙ্গে আমার একটা খটমটে সম্পর্ক আছে। একজন পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে (এবং আমার ধারণা আরও অনেক পেশার ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা এ রকম) নিশ্চয়তা এবং অনিশ্চয়তার মাঝখানে লড়াই করাই আমার কাজ। দৈনন্দিন রুটিনে কিছু নিশ্চয়তা আছে—ব্যায়াম, অনুশীলন, বেড়ানো, ঘুম, কোর্টে যাওয়ার পথে গাড়িতে বসে আধঘণ্টা একাকী গান শোনা...

একই সঙ্গে হাজারো অনিশ্চয়তা আছে জীবনে। প্রতিটি টুর্নামেন্ট খেলা হয় নতুন বল দিয়ে। একেক দিন আমরা একেক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হই। প্রতিটা দিনের আবহাওয়ার একটা নিজস্ব ধরন থাকে। কীভাবে আপনি এই সবকিছুর জন্য প্রস্তুতি নেবেন? এসব অনিশ্চয়তার বাইরে ঘুরেফিরে রুটিনটা কিন্তু একই। আপনার আগামী ম্যাচ কবে? কার বিরুদ্ধে? এরপর কোন টুর্নামেন্টে খেলবেন? বর্তমানে আপনার লক্ষ্য কী? সংবাদ সম্মেলনে সেই একঘেয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি প্রতিদিন।

দীর্ঘ ১৫ বছর এই এক রুটিনে চলার পর, নিশ্চয়তা ও অনিশ্চয়তার দোলাচলে টিকে থাকার পর, আমার আর কীই-বা বলার থাকতে পারে? ১৫ বছর অনেক লম্বা সময়। এই ১৫ বছরে ঘড়ি, ক্যালেন্ডারের পাতা, কাজের চাপ, কোনো কিছুই থেমে থাকেনি। এত কিছুর পরও প্রতিদিন মনে হয়, যেন আবার শূন্য থেকে শুরু করছি।

১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আবার খেলতে নামার মুহূর্তে মনের একটা অংশ বলছিল, আমি তো আগেও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি। ২০০৮ সালে আমার কাঁধে অস্ত্রোপচার হলো। একা একা প্রশিক্ষণে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা আমার তখনো হয়েছে। আত্মবিশ্বাস ছিল, দীর্ঘ বিরতির পরও আমি আমার সেরাটা দিতে পারব। কিন্তু মনের আরেকটা অংশ জানত, এই বিরতিটা অন্য রকম। তদন্ত, বিচার, মানসিক আঘাত—অন্য কোনো কিছুর সঙ্গেই এর তুলনা চলে না। এবারের লড়াইটা তো শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও।

জানা ও অজানা, দুটোই ছিল আমার সামনে। শুধু ফেরা নয়, আমি ফিরতে পারব—এই বিশ্বাসটাও এখানে জরুরি।

আমার প্রত্যাবর্তনের ম্যাচটার আগের রাতের মায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। যেকোনো ভ্রমণে মা সাধারণত আমার সঙ্গেই থাকেন, কিন্তু ম্যাচ দেখতে তিনি কখনোই যান না। সত্যি বলছি, গত ১০ বছরে মা বড়জোর আমার ১০টা ম্যাচ দেখেছেন। ম্যাচের রোমাঞ্চ, খেলোয়াড়দের লাউঞ্জ, দর্শকসারিতে বসে খেলা দেখে...মাকে এসব টানে না। (মায়েরা নিজেদের মতো করে কিছু নিয়ম তৈরি করে নেন।) তো যাহোক, ম্যাচের আগের রাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই মায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মা আর মেয়ের মধ্যে যে ধরনের কথা হয় আর কী। দীর্ঘক্ষণ গল্প করা শেষে হুট করেই মাকে বলে বসলাম, ‘মা, তুমি কি কাল আমার খেলা দেখতে আসছ?’ জানি না তখন আমার মাথায় কী চলছিল।

মা কিছুক্ষণ ভাবলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অবশ্যই।’ আমি বিস্ময় গোপন করে বললাম, ‘বেশ।’

এই ছোট্ট একটা মুহূর্ত, ছোট্ট একটু কথোপকথন আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার জীবনের অন্য সব ম্যাচের তুলনায় এই ম্যাচটা কেন ভিন্ন, সেটা আমি জানতাম। কিন্তু মনের খুব গভীরে, এই ম্যাচটা অন্য রকম হওয়ার পেছনে আমি একেবারেই ব্যক্তিগত একটা কারণ খুঁজে পেলাম। সব ম্যাচ তো আর মা দেখতে যান না!

মাকে শুভরাত্রি বলে বিদায় নিলাম। সে রাতে বহুদিন পর আমার খুব ভালো ঘুম হয়েছিল।

আমি মনে করি, জীবনে কিছুটা রহস্যময়তা থাকা ভালো।

আমি কখনোই চাইনি আমাকে সবাই চিনুক, ভালোবাসুক ও বুঝুক। কখনো কখনো মনে হয়, আমি বোধ হয় একটু সেকেলে। ইদানীং একটা ব্যাপার লক্ষ করছি। খেলা শেষে কোর্ট থেকে বের হয়ে লকার রুমে গিয়েই খেলোয়াড়েরা মোবাইল হাতে নেন। এমনকি গোসল সেরে নেওয়া কিংবা কাপড় বদলানোর অপেক্ষাটুকু তাঁরা করতে নারাজ। ফোন হাতে নিয়ে তাঁরা দেখেন, টুইটারে তাঁর সম্পর্কে কে কী বলছে। গত কয়েক বছর ধরেই এই ব্যাপারটা দেখছি। যেন এটা একটা প্রতিক্রিয়া-যন্ত্র, অভিমত-যন্ত্র। হয়তো ব্যাপারটা চমকপ্রদ। কিন্তু আমার কখনোই ভালো লাগে না।

আমি কি চাই না মানুষ আমার সম্পর্কে টুইট করুক, আমাকে নিয়ে কথা বলুক, আমাকে নিয়ে ভাবুক অথবা আমার খেলা দেখতে আসুক? অবশ্যই চাই। অকপটে বলি: অনেক পরিশ্রমের পর আজকের অবস্থানে পৌঁছেছি। যেই খ্যাতি আমি পেয়েছি, সেটা আমার প্রাপ্য ছিল। সব সময় বড় বড় ম্যাচ খেলতে চেয়েছি। আমি জানতাম, বড় ম্যাচ মানেই বহু লোকের মনোযোগ কেড়ে নেওয়া। লোকে কী বলছে, সেটা আমার জানার প্রয়োজন নেই। তারা আমার সম্পর্কে বলছে, এটুকু জানাই যথেষ্ট। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনূদিত