ইতিহাসের ইতিকথা জানার অপেক্ষায়

লাইব্রেরিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
লাইব্রেরিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

এক বছর আগে, ২০০৭ সালের ১৫ আগস্টের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্রধান খবর ছিল ‘আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট’। আগামীকাল ২০০৮ সালের ১৫ আগস্টের পত্রিকায় অবশ্যই প্রধান শিরোনাম থাকবে ‘আজ জাতীয় শোক দিবস রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালিত হবে’। গত বছরের সংবাদ বিবরণীতে অবশ্য রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে ‘পুষ্পস্তবক’ অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করার আগাম খবরটিও ছিল। তা হলে সরকারের তরফ থেকে না হলেও সরকারের শীর্ষমহলের সম্মানিত মর্যাদাবান ব্যক্তিরা জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। সরকারের তরফ থেকে অগ্রিম কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে একটি ‘শোক দিবস’ পালন করা হয়নি; বরং সেই দিনটিতে সরকারি নির্দেশনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেই প্রশাসনে ছিল সদ্য ক্ষমতা-ত্যাগকারী জোট সরকারের ভূত। তাই বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা করছি।

গত বছর রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান ও সেনাপ্রধানের বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদানের রীতিটি পালিত হয়েছিল ভিন্ন রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। এ সম্পর্কে প্রথম আলো, ১৬ আগস্ট ২০০৭ সংখ্যাটির একটি প্রতিবেদন পুনরুল্লেখ করছি। প্রতিবেদনটি একটুখানি দীর্ঘ মনে হতে পারে, তবে এর বিশেষত্ব রয়েছে। দীর্ঘ ছয় বছর পর দিনটি রাষ্ট্রীয় ও সরকারি মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে ‘শোকাহত’ দিনটি কীভাবে এল আর গেল তার পর্যালোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বিশেষ করে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে প্রথমেই বলা হয়েছিল, পঁচাত্তরের পর বিচিত্র পরিবেশে রাজনীতিবিহীন ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি’তে শোকাবহ ১৫ আগস্ট পালিত হয়েছে। আমার মতে, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি’ না বলে সরকারের ও রাষ্ট্রের পরস্পরবিরোধী অবস্থান বলাই সঠিক হতো।

গণভবনে মুক্তিযুদ্ধকালীন পোস্টার দেখছেন বঙ্গবন্ধু। ছবি: দিলীপ ব্যানার্জি
গণভবনে মুক্তিযুদ্ধকালীন পোস্টার দেখছেন বঙ্গবন্ধু। ছবি: দিলীপ ব্যানার্জি

সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি ছিল, ‘প্রথম ২১ বছর ১৫ আগস্ট পালিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় অবহেলায়। অতঃপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস বাতিল করে।’ প্রতিবেদনের পরবর্তী বাক্যটিকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে যখন বলা হলো, ‘বিএনপি-জোট সরকার জাতীয় পতাকা বিধি সংশোধন করে সরকারিভাবে নির্ধারিত দিন ছাড়া জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।’ বাক্যটির অন্তর্নিহিত অব্যক্ত কথাটি হচ্ছে, ১৫ আগস্ট জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো। সেদিনের পত্রপত্রিকায় আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ খবর ছিল, একই দিনে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ‘জন্মদিবস’ পালন করবেন। অতঃপর বঙ্গবন্ধু হত্যার দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে শোক পালনে বিএনপি-জোট সরকারের অনীহা শুধু নয়, অমর্যাদার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। কারণটি ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন আছে কি? বরং মৃত্যু বা হত্যার দিনে কারও জন্মের বা পুনর্জন্মের সম্পর্ক নিয়ে যদি কারও মনে বিভ্রান্তি জেগে থাকে, তা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক অর্থহীন। তার পরও ১৫ আগস্ট সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক দলের অ্যালার্জি অথবা হীনম্মন্যতার একটুখানি আলোচনার অবকাশ রয়েছে। কারণ, ১৫ আগস্টের বেনিফিসিয়ারি বা সুফল ভোগকারীদের নিয়ে নানা জন নানা কথা বলতে পারে বইকি।

অপ্রিয় প্রসঙ্গ নিয়ে আর আলোচনা নয়, ২১ বছর যা-ই ঘটুক, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আবার রাষ্ট্রীয় ও সরকারি পর্যায়ে ১৫ আগস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস’ ঘোষণা করল। পতাকা অর্ধনমিত হলো, সরকারি ছুটি পুনর্বহাল হলো। পাঁচ বছর পর আবার বিএনপি-জোট সরকার ক্ষমতায় এসে দিবসটিকে রাষ্ট্রীয় শোক দিবসের মর্যাদাচ্যুত করল। তারপর দিনে দিনে দিন যে গেল। বিএনপি-জোটের বৈরী পরিস্থিতির অবসান ঘটল, কয়েকটি নাটকীয় ঘটনার পর স্থায়ী হলো ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকার। প্রথম বছরই বিএনপির রাষ্ট্রপতি আর নির্দলীয় প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান টুঙ্গিপাড়ায় ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতিকে আবেগাপ্লুত করলেন। তবে অন্য যেসব কাণ্ড ঘটেছিল, তা জাতিকে অবাক করেছিল। প্রথম আলোর প্রতিবেদন পড়লাম, ‘সরকার বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে ২০ জনের বেশি একত্র হতে পারবেন না বলে নির্দেশ দিয়েছে।’ আরও আছে, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচারের রায় কার্যকরী করার দাবিতে কোনো কর্মসূচি দেওয়া যায়নি। অনুমতি না পাওয়ায় ১৬ আগস্টের আলোচনা সভা বাতিল করা হয়েছে। আলোচনা সভার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল, মাইক ব্যবহার না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ এক বছর পর প্রশ্ন করা যেতে পারে তখন সেই নিষেধাজ্ঞা আর নির্দেশ কে দিয়েছিলেন। তাঁরা আজ কী বলেন, জানতে ইচ্ছা করে।

জনগণের মাঝে বঙ্গবন্ধু। ছবি: পাভেল রহমান
জনগণের মাঝে বঙ্গবন্ধু। ছবি: পাভেল রহমান

পুরোনো সেই দিনের কথা বর্ণনা করলাম পাঠক সমীপে একটি মূল বক্তব্য পেশ করার জন্য। জাতি শোকাহত কি না জানি না, তবে রাষ্ট্র ও সরকারের নীতি কিংবা ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের ব্যাপারে মনোভাবের পরিবর্তনের ভিন্ন একটি তাৎপর্য অন্তর্নিহিত রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত ১৫ আগস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস’ পালনের বিএনপি আমলের বাতিল সরকারি কার্যক্রম পুনর্বহাল করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিদ্ধান্তটি প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করে, অন্য সব অপছন্দের রায়ের বিরুদ্ধে যেমনটি করেছে তেমনি আদালতের এই নির্দেশনাটি বাতিলের জন্য কোনো ‘আপিল’ করেনি। কেন যেন মনে হচ্ছে, তারা খুশি হয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে, এ ধরনের কিছু ঘটুক, তারই অপেক্ষায় ছিল। অর্থাৎ তাদের মনের মধ্যে ‘সরকারি কোনো পদক্ষেপ’ নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব অথবা মনের ভেতরে কাতরতা ছিল, তা দূর করার উপলক্ষটি পেয়ে স্বস্তি বোধ করেছে। তাই বিনা দ্বিধায় এবার ১৫ আগস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস ও ছুটি’ ঘোষণায় ইতস্তত করেনি।

জাতির পিতার প্রতি বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের শ্রদ্ধাবোধ এবং তাঁর হত্যাকাণ্ডের জন্য বেদনা বোধের এই বহিঃপ্রকাশ তাদের মর্যাদাবান করেছে। আমি আরও আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করছি, সেনাপ্রধান মঈন উ আহমদ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার আসনে অধিষ্ঠিত করার প্রসঙ্গটি নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ, তাঁর সহকর্মীরা এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশন যুদ্ধাপরাধীদের ভোটাধিকারের প্রসঙ্গটি আলোচনায় এনেছেন। তার পরও বুঝতে হয়েছে, একটি নির্দলীয় সরকারকে কোনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো অন্তর্নিহিত প্রতিবন্ধকতা থাকে। যে কারণে এ সরকারের প্রশংসিত সিদ্ধান্তটি নিতে বিলম্ব হয়েছে। মহামান্য আদালত সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করেছেন।

দেশবাসীর ভালোবাসায় সিক্ত বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
দেশবাসীর ভালোবাসায় সিক্ত বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত

আপনজন হারানোর বেদনা যখন মনের ভেতর গুমরে ওঠে, তবে তা চাপা থাকে, কিন্তু পারিপার্শ্বিক কারণে সময়ে তা প্রকাশ করা যায় না। যেমনটি যায়নি ২১ বছর। বদ্ধ ঘরে কোটি নর-নারী চাপা স্বরে ফুলে-ফুলে কেঁদেছে, প্রকাশ্যে বিলাপ করতে পারেনি। ফখরুদ্দীন সরকার সেই বদ্ধ আবেগের বহিঃপ্রকাশের পথটি দুই বছর পর আবার খুলে দিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার ইতিকথার এখানেই ইতি ঘটতে পারে না। সরকারের গৃহীত ‘শোক দিবস’ ঘোষণা হোক ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ করার প্রাথমিক পদক্ষেপ। বর্তমান নির্মোহ সরকারকে বঙ্গবন্ধু হত্যার গ্লানি থেকে জাতিকে মুক্ত করার প্রক্রিয়াটি শেষ করতে হবে। এ জন্য বৈচারিক প্রক্রিয়ার দোহাই দিয়ে চূড়ান্ত বিচার কেন বিলম্বিত করা হয়েছে, তা জানতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার মামলাটি প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক কারণেই ঝুলে আছে, তা নিশ্চয়ই অরাজনৈতিক সরকার অনুধাবন করবে। আমি ইতিপূর্বে বারবার প্রশ্ন করেছি, ‘বিব্রত হওয়ার’ দোহাই দিয়ে কতিপয় বিচারক মামলাটি ঝুলিয়ে দিয়ে সংবিধান (তৃতীয় তফসিল-১৪৮ অনুচ্ছেদ-৬ উপচ্ছেদ-‘আমি অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব’) লঙ্ঘন করেছেন। আমার সঠিক বা বেঠিক যুক্তি ছিল, তাঁরা বিরাগের বশবর্তী হয়ে শপথ ভঙ্গ করেছিলেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানও তাঁর স্মৃতিকথায় প্রশ্ন করেছেন-‘কোন বিচারপতি কেন বিব্রত হয়েছেন, তা কেন বলেননি?’ বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য অভিযুক্তদের কারও প্রতি কি তাঁদের কারও অনুরাগ ছিল, নাকি বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিরাগ ছিল, যে কারণে মামলাটির আপিল শুনানিতে বিচারপতি পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল? এ দ্বন্দ্বটিরও এখন মীমাংসা হওয়ার সময় এসেছে।

তাই বলছিলাম, নিছক রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালনের একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, জাতির পিতার হত্যাসম্পর্কীয় সব গূঢ় তথ্য জানার জন্য বর্তমান সরকারের কাছে আবেদন, বঙ্গবন্ধু হত্যা-রহস্যের উদ্‌ঘাটনে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে দিয়ে যান। কেনেডি হত্যার পর জাস্টিস ওয়ারেন কমিশন গঠিত হয়েছিল, ইন্দিরা গান্ধী হত্যার ফৌজদারি আইনে বিচার হলেও রহস্য উদ্‌ঘাটনের জন্য উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হয়েছিল।

শুধু বাংলাদেশের স্থপতি বা জাতির পিতা বলে নয়, একজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যার ঘটনার ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ে ইতিকথার শেষ পাতাটি লেখার জন্য হলেও একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। শোক দিবসকে সরকারি মর্যাদা দেওয়া হলো কি হলো না, তাতে কিছু যায় আসে না। শোক প্রকাশে কাঁদার জন্য আফ্রিকার কোনো কোনো গোষ্ঠী নাকি লোক ভাড়া করে; আমাদের কান্না নিজেরাই কেঁদে থাকি-সরকারের কোনো নির্দেশের অপেক্ষায় থাকি না। আনুষ্ঠানিক দিবস ঘোষণা অথবা হত্যার চূড়ান্ত বিচার বিলম্বিতকরণকে এ জন্যই আমি গুরুত্ব দেব না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র উদ্‌ঘাটন করে ভিন্ন ভিন্ন সরকারের আমলে ১৫ আগস্ট সরকারিভাবে উদ্‌যাপন করা বা না করার রহস্যটি কী তা জানতে হবে। সর্বোপরি হত্যা মামলার যে রায়ই হোক, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের পেছনের সব কাহিনি জানার জন্য হলেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি তদন্ত প্রক্রিয়া শুধু এ সরকারই শুরু করে দিয়ে যেতে পারে।

(প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মুসার এই লেখাটি ২০০৮ সালের ১৪ আগস্ট প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল।)