ভেতরের আগুনটা হারিয়ে ফেলো না:আডা হেজেরবার্গ

আডা হেজেরবার্গ
আডা হেজেরবার্গ
নরওয়ের ফুটবলার আডা হেজেরবার্গ। ২০১৭ সালে বিবিসি তাঁকে সেরা নারী ফুটবলারের স্বীকৃতি দিয়েছে। এ বছর জিতেছেন ব্যালন ডি’অর। পুরস্কারের পেছনের গল্প লিখেছেন দ্য প্লেয়ারস ট্রিবিউনে।


এটা আমার জীবনের সেরা রাতের গল্প। ব্যালন ডি’অর অনুষ্ঠানের সেই মুহূর্তের গল্প, যা আমি জীবনেও ভুলব না। যদি ২০০ বছর বেঁচে থাকি, তবুও না!

গল্পের শুরুটা আসলে সেই রাতের আরও দুদিন আগের, খুব সহজ একটা বাক্য দিয়ে। ‘আডা, তুমি কি একটা কথা গোপন রাখতে পারো?’

প্রশিক্ষণ শেষে অলিম্পিক লিওনেইসের একজন সহকারী কোচ আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে নিলেন। বললেন, ‘শোনো, তুমি কথাটা কাউকে বলতে পারবে না।’

আমি বললাম, ‘আচ্ছা...?’

তিনি আবার বললেন, ‘কাউকে বলবে না তো?’

বললাম, ‘না, কাউকে বলব না।’

এবং তারপরই তিনি বললেন, ‘তুমি ব্যালন ডি’অর জিততে যাচ্ছ।’

শব্দটা শোনার পর আমার মনস্পটে যেন ৭ হাজার ছবি ভেসে উঠল। কারণ, এটা শুধুই ব্যালন ডি’অর নয়। এটা নারীদের প্রথম ব্যালন ডি’অর। আমি একই সঙ্গে কাঁদতে ও হাসতে শুরু করলাম।

তিনি বললেন, ‘তুমি কথাটা গোপন রাখবে তো?’

বললাম, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।’

আমি কথাটা গোপন রাখতে পেরেছিলাম ১০ মিনিটের জন্য। গাড়িতে পৌঁছেই ফেসটাইম (আইফোনের ভিডিওচ্যাটের অ্যাপ—বি. স.) করলাম আমার মা-বাবাকে। সে সময় তারা আমার বড় বোন অ্যানড্রিনের বাড়িতে, পিএসজিতে বেড়াতে গিয়েছিল। মোবাইলের পেছনের ক্যামেরা অন করে একটা বড় রাস্তা দেখিয়ে মা আমাকে বলছিল, ‘দেখো, কী সুন্দর!’

আমি বললাম, ‘মা, একটা ঘটনা ঘটেছে। বললে তুমি বিশ্বাস করবে না।’

মা দ্রুত সামনের ক্যামেরা অন করল, আমি তাঁর চিন্তিত মুখ দেখতে পেলাম। বলল, ‘কী হয়েছে? তুমি ঠিক আছ তো?’

বললাম, ‘মা, আমি ব্যালন ডি’অর জিততে যাচ্ছি।’

সে কাঁদতে শুরু করল। আমার বাবা বিশ্বাস করতে না পেরে দুদিকে মাথা নাড়তে লাগল। ফোন রাখার পর স্তব্ধ হয়ে গাড়িতে বসে ছিলাম। আমি নরওয়ের ছোট্ট একটা গ্রামের একটা ছোট্ট মেয়ে। আমি কীভাবে ব্যালন ডি’অর জিতি! এটা নিশ্চয়ই স্বপ্ন।

আমার ছেলেবেলার একটা গল্প বাবা প্রায়ই বলত।

আমরা ছিলাম একটা ফুটবল পরিবার। মা ও বাবা দুজনই ছিল কোচ, বোনও দারুণ খেলত। আমি তার চেয়ে দুই বছরের ছোট। অতএব আমি সব সময় বসে বসে খেলা দেখতাম। সঙ্গে থাকত বই আর সোডার ছোট্ট বোতল।

আমার বোন শুধু ছেলেদের সঙ্গে খেলতই না, সে ছিল ছেলেদের দলের অধিনায়ক। আর কোচ? আমার মা। ৭০০০ বাসিন্দার একটা শহরে এটা সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার। এখানে সত্যিকার সমতার স্বাদ পাওয়া যায়। আমার বোন কেন অধিনায়ক বা আমার মা কেন কোচ, এ নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি। এখানে মেয়েদের দল, ছেলেদের দল বলে কিছু ছিল না। ছিল কেবল ফুটবল দল।

একদিন আমি ঘাসের ওপর বসে বড় বোনের খেলা দেখছিলাম। এমন সময় আমার মা-বাবার মধ্যে একজন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আডা, বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?’

আমি সম্ভবত বইয়ের মধ্যে খুব বেশি ডুবে ছিলাম, অতএব আমার ভাবতে একটু সময় লাগল।

তিনি আমাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করলেন, ‘তুমি কি বড় বোনের মতো ফুটবলার হতে চাও?’ আমি খুব বিরক্তি নিয়ে বলেছিলাম, ‘না। অন্তত আমি একটা কাজের কাজ করতে চাই।’

বাবা এখনো ঘটনাটা মনে করে হা হা করে হাসে। আমরা নরওয়ের মানুষেরা আসলে ভীষণ বাস্তববাদী।

অবশ্যই আমার এই ভাবনা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। যখন খেলা শুরু করলাম, আমি ফুটবলের প্রেমে পড়ে গেলাম। বুঝে গেলাম, কেবল মজার জন্য আমি খেলতে চাই না। এটা আমার কাছে জীবন-মরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ। আমি থিয়েরি হেনরির মতো হতে চেয়েছি—একজন পরিপূর্ণ ফুটবলার। আমি বাড়ি ছেড়ে বিদেশে যেতে চেয়েছি। আমি বড় হতে চেয়েছি।

আমার বয়স যখন ১১ বছর, বাবা বলেছিল, ‘তুমি যদি সত্যিই ফুটবলার হতে চাও, আমরা শতভাগ তোমার পাশে আছি। আমরা তোমার জন্য সব করব, যদি তুমি সত্যিই চাও।’ আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ, আমি চাই। ১০০০% নিশ্চিত।

টাকা ছিল না। কিন্তু আবেগ ছিল। যখনই একটা ম্যাচ হেরেছি, মনে আছে বাইক চালিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমি বাড়ি ফিরেছি। নরওয়ের একটা নাম না জানা জায়গায় বাচ্চাদের একটা খেলা, তাতে কারও কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমার যায় আসে।

এই লেখাটা যেই মেয়েরা এখন পড়ছে, তাদের আমি একটা কথা বলতে চাই, তুমি তোমার ভেতরের আগুনটা হারিয়ে ফেলো না। তোমার আগুনটা কেউ কেড়ে নিতে পারে না। তোমার যদি বড় স্বপ্ন থাকে, তোমার ভেতরের আগুনই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।

শুধু মেধায় হবে না। ধৈর্যে হবে না। তোমাকে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে, তোমার শেষ সীমানায় ঠেলে দেওয়া হবে। একটা ছেলেকে যতটা কষ্ট করতে হয়, তোমাকেও ততটাই করতে হবে, যদিও তুমি বিনিময়ে টাকা পাবে অনেক কম। তুমি কাঁদবে। সব ছেড়েছুড়ে দেবে। ব্যথা অনুভব করবে। মনে আছে, আমি যেদিন অবশেষে দেশের বাইরে খেলার সুযোগ পেলাম, পূর্ব জার্মানির টার্বাইন পোটসড্যামের সঙ্গে খেলতে নেমে আমি খুব জড়সড় হয়ে ছিলাম। কিন্তু খেলার ফাঁকে ঠিকই আমার হাইস্কুলের পড়াগুলো শেষ করার চেষ্টা করতাম।

দৈনিক তিনবার প্রশিক্ষণ হতো, হোক বৃষ্টি বা তুষারপাত। এটা সত্যিই খুব নিষ্ঠুর। কিন্তু প্রত্যেক খেলোয়াড় তাদের শতভাগ ঢেলে দিয়েছে। প্রতিদিন। অজুহাত নেই, অভিযোগ নেই। বাড়ি ফিরে প্রতি রাতে গায়ে এত ব্যথা হতো যে সন্ধ্যা সাতটায় আমার হোমওয়ার্ক ঘরময় ছড়িয়ে রেখে তার মধ্যেই আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। এই মুহূর্তগুলো কেউ দেখতও না। কিন্তু আমি তো আমার ভেতরের আগুন হারাতে পারি না।

আমি সমতা সম্পর্কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারি। বলতে পারি ফুটবলে ও সমাজে কী কী পরিবর্তন আসা দরকার। কিন্তু দিন শেষে এ সবকিছুর মূলে হলো—সম্মান।

আমি কখনো নিজেকে একজন নারী ফুটবলার হিসেবে দেখিনি। যখন নরওয়ের গ্রামে ছিলাম, তখনো না। জার্মানিতে যখন ভীষণ কষ্টে দিন কেটেছে, তখনো না। যখন অবশেষে লিয়নে খেলার সুযোগ হলো, তখনো না। আমরা আর যেকোনো ফুটবলারের মতোই ভীষণ কষ্ট করেছি। একই রকম অভিজ্ঞতা ও হৃদয় বেদনার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। একই রকম ত্যাগ করেছি। স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে পরিবারকে পেছনে ফেলেছি। সবকিছুই সম্মানের জন্য।

এ কারণেই ২০১৮ সালের ব্যালন ডি’অরের সেই মুহূর্তটা আমার চেয়ে বড়। এই মুহূর্তটা আমার নয়। এটা আমাদের।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ