সুস্বাস্থ্য পাওয়ার কোনো শর্টকাট নেই

>

লোকে তাঁকে চেনে টার্মিনেটর নামে। হলিউডের নামকরা সব মারকুটে ছবিতে অভিনয় করেছেন। দুই মেয়াদে পালন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নরের দায়িত্ব। তিনি আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগার। ২ জানুয়ারি তাঁর এই অনুপ্রেরণাদায়ক লেখা প্রকাশ করেছে সিএনএন।

আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগার
আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগার

আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে, লন্ডনের ভিক্টোরিয়া প্যালেস থিয়েটার মঞ্চে আমি মিস্টার ইউনিভার্সের ট্রফিটা ওপরে তুলে ধরেছিলাম। তারও আগে থেকে শুরু হয়েছিল আমার ফিটনেস ধরে রাখার যুদ্ধ।

কিন্তু কেবল ট্রফি তুলে আমার মন ভরেনি। আমি পুরো ‘ফিটনেস ইন্ডাস্ট্রি’টাকে তুলে ধরতে চেয়েছি। চেয়েছি সারা বিশ্বের মানুষ যেন ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাবার আর স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের গুরুত্বটা বোঝে, অনুপ্রাণিত হয়।

এখন আমরা সবাই এসবের উপকারিতা জানি। কিন্তু ৫০ বছর আগে কাজটা ছিল ভীষণ কঠিন। জিমের সংখ্যা ছিল খুব কম। যে কয়টা ছিল, বেশির ভাগই অন্ধকারাচ্ছন্ন, শ্রীহীন। চিকিৎসকেরা ভারোত্তোলন করতে নিষেধ করতেন। বলতেন, এটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। আমি কয়েকজন চলচ্চিত্র তারকাকে চিনি, যাঁরা শরীর গঠনের উপকারিতা বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু জনসমক্ষে তাঁরা মিথ্যা বলতেন, বলতেন তাঁদের শরীর স্বভাবতই পেশিবহুল। এমনকি কয়েকজন পেশাদার অ্যাথলেটও জিম এড়িয়ে চলতেন। কারণ, প্রচলিত ধারণা ছিল, ভারোত্তোলন করলে শরীরে জড়তা চলে আসে।

অনেক দূর পথ আমরা পেরিয়ে এসেছি। ইন্টারন্যাশনাল হেলথ, রেকেট অ্যান্ড স্পোর্টসক্লাব অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ছয় কোটির বেশি আমেরিকান এখন হেলথ ক্লাবের সদস্য। ফুড ইন্ডাস্ট্রি ডটকম বলছে, দেশে মুদিদোকান আর জিমের সংখ্যা প্রায় সমান। আমি খুবই আনন্দিত যে এখন শরীরচর্চা করার অনেক জায়গা আছে, হোক সেটা বক্সিং জিম বা ইয়োগা স্টুডিও।

কিন্তু আমাদের আরও ভালো করার জায়গা আছে। সুস্বাস্থ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়া সত্ত্বেও স্থূলতা চোখে পড়ছে মহামারি আকারে। ইউএসএ টুডে বলছে, ৬৭ শতাংশ জিমের সদস্য কেবল সদস্য হয়েই বসে আছেন, কখনোই তাঁরা জিমে যান না। নতুন বছরে যাঁরা নিজেকে বদলানোর প্রতিজ্ঞা করেছেন, ইউএস নিউজ ও ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট বলছে, ৮০ শতাংশ মানুষ ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই হাল ছেড়ে দেবেন।

আমাদের সামনে এখন অনেক তথ্য, বাজারে সুস্বাস্থ্য ধরে রাখার জন্য নানা রকম পণ্য, জিমের সংখ্যাও প্রচুর। তাহলে কেন আমরা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারছি না?

কারণ, এখন কঠোর পরিশ্রম আর নিখাদ বিজ্ঞানের জায়গা দখল করেছে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর জাদুকরি ওষুধ।

যখন কেউ তোমাকে বলছে, মাত্র ২৮ দিনেই পাবেন পেশিবহুল দেহ। কেউ বলছে, একটা বিশেষ চা খেলেই কমবে ১০ পাউন্ড ওজন কিংবা চোখের সামনে ভেসে উঠছে চটকদার বিজ্ঞাপন; এটা সহজেই অনুমেয় যে কেন মানুষ পরিশ্রম করার আগ্রহ হারাচ্ছে।

মানুষকে সত্যি কথাটা বলার সময় এসেছে। একটা সুস্থ, সবল আমেরিকা গড়ে উঠবে তোমাকে দিয়েই। কোনো জাদুকরি ওষুধ নেই, শর্টকাট নেই, প্রতারণা করার সুযোগ নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য একেকজনের কৌশল একেক রকম হতে পারে, কিন্তু প্রতিজ্ঞা, ধৈর্য আর একাগ্রতা লাগবেই। আমি শুনতে পাচ্ছি, আপনারা অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, ‘তোমার জন্য এ কথা বলা সহজ আর্নল্ড। সারা জীবন তুমি ফিটনেস ধরে রাখার পেছনেই ছুটেছ, আর তোমার স্বাস্থ্য সব সময় ভালো ছিল।’

কিন্তু কদিন আগেই আমাকে আবার গোড়া থেকে সব শুরু করতে হয়েছে, অনেক কিছু শিখেছি। গত বসন্তে ওপেন হার্ট সার্জারি করার পর অন্যের সাহায্য নিয়ে হেঁটেছি। কখনো কখনো মনে হতো, আর কখনো পুরোনো আমিকে ফিরে পাব না।

তিন মাস পর টার্মিনেটর সিরিজের একটা নতুন ছবিতে অভিনয়ের জন্য আমি সেটে হাজির হয়েছি। আপনারা জানেন, দুর্বল টার্মিনেটর বলে কিছু নেই। কিছু নির্দিষ্ট ব্যায়াম আর ডায়েটের মাধ্যমে আবার নিজেকে ফিরে পেয়েছি, আপনাদের এ কথা বলতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু সত্যিটা হলো, আমি স্রেফ হেঁটেছি। আমার সৌভাগ্য, আমাকে সাহায্য করার জন্য একটা বড় দল কাজ করেছে। একসময় বাড়ির উঠানে সাইকেল চালাতে শুরু করেছি। ‘সিক্স প্যাক’ শরীর বানানোর লক্ষ্য আমার ছিল না, লক্ষ্য ছিল প্রতিদিন নিজেকে একটু হলেও উন্নত করব।

অনেকেই ভাবেন, হঠাৎ একদিন তাঁরা একটা সুইচ চাপবেন আর স্বাস্থ্যবান হয়ে যাবেন। এ রকম কোনো সুইচ নেই। প্রতিটা ছোট ছোট পদক্ষেপ আপনাকে একটি স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে। আমরা সবাই ভাবি, আমি একাই পারব। কিন্তু যেমনটা আমি সব সময় বলি, কেউ নিজেই নিজেকে গড়তে পারেন না। সাহায্য সবারই লাগে—এমনকি টার্মিনেটরেরও!

অতএব আপনাদের জন্য আমার চ্যালেঞ্জ: নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা করার দরকার নেই। ঘরে বসে হার্টের অসুখ বা কোনো জরুরি অবস্থার জন্য অপেক্ষা করবেন না। এখনই শুরু করুন। সঙ্গে একজন বন্ধুকেও নিন।

বলছি না সব সুস্বাদু খাবারকে দূরে ঠেলে দিন। কারণ, আমি নিজেও কখনো সেটা করতে পারিনি। শুধু বলছি প্রতিদিন, আগের দিনের চেয়ে নিজেকে একটু উন্নত করুন। যাঁদের আপনি ভালোবাসেন, তাঁদের বলুন আপনার সঙ্গে যোগ দিতে। এটা খুব সহজ প্রতিজ্ঞা। ‘সিক্স প্যাক অ্যাবস’ বানানোর মতো এই প্রতিজ্ঞাটা খুব চটকদার নয়, কিন্তু এটাই আমাদের সুস্বাস্থ্যের যুদ্ধকে সফল করবে।

আগের দিন যদি ৫ হাজার কদম হাঁটেন, আজ আপনার লক্ষ্য হোক ৫০০১ কদম। গতকাল যদি এক ধরনের সবজি খেয়ে থাকেন, আজ দুধরনের সবজি খান। আজ যদি একটা বুকডন দিয়ে থাকেন, কাল দিন দুটা।

এই ছোট ছোট জয় উদ্​যাপনে আপনারা আমার সঙ্গে যোগ দিলে. সবাই সবাইকে সহায়তা করলে আমরা একটা স্বাস্থ্যবান দেশ পাব। জানুয়ারি শেষ হওয়ার আগেই অন্য সবাই যখন হাল ছেড়ে দেবেন, আমরা সঠিক পথে থাকব ঠিকই।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ:

মো. সাইফুল্লাহ, সূত্র: সিএনএন