যে জীবন শিশিরের
১২.১২.১২। উম্মে আহমেদ শিশির আর সাকিব আল হাসানের বিয়ের দিন। ছয় বছর পেরিয়ে সপ্তম বছরে পড়ল ওঁদের যুগলজীবন। যে শিশির ১১ বছর বয়সে ঢাকা থেকে চলে গেছেন আমেরিকায়, সেখানেই থেকেছেন মা-বাবার সঙ্গে, পড়েছেন আমেরিকান স্কুল-কলেজে; যিনি কোনো দিনও ক্রিকেট দেখতেন না; কেমন আছেন তিনি পৃথিবীর এক নম্বর অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যৌথ জীবনে?
এই প্রশ্নে শিশিরকে হাসিখুশি দেখায়। শীতের অপরাহ্ণে বনানীর অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ছাদে পেছনে ম্যাজেন্টা রঙের ফুল, আকাশঘন নীল, রোদ এসে পড়েছে তাঁর চুলের পেছনে; শিশিরের চোখের কোণে খুশির ঝিলিক খেলে যায়। পৌষের শেষের এই দিনটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন, তাঁদের তিন বছরের মেয়ে আলাইনা প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুলে গেছে সেদিন।
সকাল সাড়ে আটটায় স্কুল। শিশির সকাল সকাল ঘুম থেকে জেগে মেয়েকে রেডি করিয়ে রাখেন। আলাইনা স্কুলে যেতে খুব পছন্দ করে। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনে ‘খেলা-খেলা’ স্কুলে সে গিয়েছেও এর আগে। ঢাকায়ও এ স্কুল ও স্কুল করে সেদিনই সে শুরু করল স্কুল, দস্তুরমাফিক। স্কুলে যাবে বলে মেয়ে ভোরেই ঘুম থেকে জেগে গেছে। মেয়েকে রেডি করিয়েছেন মা, আর তাকে স্কুলে নিয়ে গেছেন বাবা সাকিব আল হাসান। বিপিএলের ব্যস্ততার মধ্যেও সাকিব মেয়ের স্কুল ডিউটিটা ঠিকই করেছেন।
শিশির হাইস্কুল শেষ করে তখন কেবল আন্ডারগ্র্যাড করছেন। ২০১১ সালের কথা। তাঁর পড়ার বিষয়টাও ছিল সেই রকম—সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং। বাপ রে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং! আমি চোখ কপালে তুলি। শিশির গম্ভীরমুখে বোঝানোর চেষ্টা করেন, বুঝলেন না, বাঙালি বাবা-মা তো ছেলেমেয়েকে ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া আর কিছু বানানোর কথা ভাবতেই পারেন না।
সেই সময় ফেসবুকে পরিচয় সাকিব আল হাসানের সঙ্গে। তখন আমেরিকায় বসে শিশির টেলিভিশনে দেখতে লাগলেন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, আর তাতে কিনা রিকশায় চড়ে মাঠে ঢুকলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। পর্দায় প্রথম সাকিব আল হাসানকে দেখে শিশিরের মনে হলো, আরে এ তো ভীষণ হ্যান্ডসাম।
তারপর শিশির কলেজের স্টাডি ট্যুরে এলেন ইউরোপে। সাকিবকে লিখলেন।
সাকিব বললেন, তুমি কোথায়?
আমি? আমি আমার আঙ্কেলের বাড়ি। লন্ডনে।
আমিও তো লন্ডনে।
টেলিফোন নম্বর বিনিময় হলো। সাকিব বললেন, আরে আমি তো দশ মিনিটের দূরে। চলে এলেন সাকিব, শিশিরের আঙ্কেলের বাড়ি। আর তখন সাকিবকে দেখে তাঁর মনে হলো আরে এ তো ভীষণ লম্বা!
এর এক বছর পর এল সেই ১২ ডিসেম্বর ২০১২।
তো স্বামী হিসেবে সাকিব কেমন?
ভীষণ সাপোর্টিভ। ও খুব সাপোর্ট করে। অনেক সাহায্য করে। সহযোগিতা করে। আল্লাহ মাফ করুক, ধরা যাক, আমার একটু ঠান্ডা লেগে গেল, আলাইনাকে কিন্তু সে–ই সামলায়। আর আমার পুরো পরিবারই আমাকে সাহায্য করে। আমার শাশুড়ি যখন ঢাকায় থাকেন, তখন তো তিনিই করে দেন অনেক কিছু। এখন যেমন আমার মা-বাবা আছেন ঢাকায়। বেড়াতে এসেছেন। অনেক সাপোর্ট পাই।
আর আমরা দুজন দুজনকে সমর্থন দিই। মেয়ের ভালো থাকাটাই তো আসল, তাই না!
আচ্ছা আচ্ছা শিশিরকে তো দেখা গেল, ডিসেম্বরে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে। ঢাকা ডায়নামাইটসের জার্সি পরা।
শিশির বললেন, সাকিব তো চায় আমি খেলা দেখতে যাই।
আচ্ছা আচ্ছা, আইপিএলে তো শাহরুখ খানের সঙ্গে দেখা হতো? কোনো বিশেষ ঘটনা বা স্মৃতি?
শাহরুখ খান খুব মিশুক প্রকৃতির। ডাউন টু আর্থ। মনেই হবে না যে শাহরুখ খানের সঙ্গে আছি। খুব আমুদে। হইচই–নাচানাচি। সাকিব তো মূর্তির মতো সোজা দাঁড়িয়ে থাকে। ওকে শাহরুখ নাচানোর জন্য যে কত টানাটানি করে! একটা মজার টিপস শাহরুখ শিখিয়ে দিয়েছেন সাকিবকে, যত ক্লান্তিই থাকুক, বাড়িতে ফিরে বলবে না তুমি টায়ার্ড। ভীষণ এনার্জেটিক প্রমাণ করবে নিজেকে। বলো, কী করতে হবে। চলো, বাইরে যাই।
আচ্ছা, শিশিরের প্রিয় বেড়ানোর জায়গা কোনটা?
ক্যারিবিয়ান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ। নীল সমুদ্র। আছড়ে পড়া ঢেউ। আরামপ্রিয় মানুষ। এলিয়ে শুয়ে আলসেমি করে কাটানো উজ্জ্বল দিন।
শিশিরের প্রিয় খাবার?
আমি তো ফুডি না। তবে আমার ডালভাত না হলে চলেই না।
ডালভাত? আমি তো কখনো শিশিরকে খেতে দেখিনি।
না-না, বাইরে খেতে কেমন লাগে। বাসায় ফিরে এসেই ডালভাত খাই।
সাকিবের প্রিয় খাবার?
স্টেক। ডিমপোচ। আলুভর্তা।
শিশির তো ক্রিকেট বোঝেন না!
আগে একদমই বুঝতাম না। দুই বছর লেগেছে ক্রিকেট বুঝতে।
তবে যে সাকিব বলল, শিশির আমাকে আগের রাতে ফোনে বলেছে, পারলে তুমিই পারবা? তাই না আমরা একটা টেস্টে জিতলাম!
অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে! হ্যঁা বলেছিলাম। ওর ওপরে আমার আস্থা আছে তো। আমি বললাম, পারলে তুমিই পারবা। তুমি মন দাও। তুমি ভালো করলেই দেখো বাংলাদেশ জিতে যাবে। ৮৪ রান আর দুই ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়ে সাকিব বাংলাদেশকে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্টে জিতিয়েছিলেন।
ঠিক ঠিক। সাকিব তো পরাজয় মানতে পারেন না। আমাকে বলেছেন, ছোটবেলায় ব্যাডমিন্টন খেললেও হারতে চাইতেন না। বাসায় কি লুডু খেলা হয়?
হ্যঁা। আমাদের তো লুডু টুর্নামেন্ট হয়। আমি, সাকিব, আমার শাশুড়ি, আমার মা। লুডু প্রতিযোগিতা হয়। তো আমার বিরুদ্ধে খেললে তো আমাকে খেপানোর জন্য চোরামি করে। আমিও করি।
আলাইনাকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেন?
না-না। আমাদের স্বপ্ন আমরা ওর ওপরে চাপাতে চাই না। ওর যা ভালো লাগবে, ও তাই করবে। নিজের স্বপ্ন ও নিজে বেছে নেবে। আমরা শুধু প্যারেন্টাল গাইডেন্সটা দেব। আমরা চাই আলাইনা ভালো মানুষ হোক।
শিশিরের কোনো হবি?
ফ্যাশন ডিজাইনিং। এইটা!
মডেলিং করা হচ্ছে?
না। এখন তো আলসেমি লাগে। নাবিলা বুটিক শপের ফটোসেশন করলাম। আমি ওদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। জড়োয়া হাউস আর কুমারিকা করেছি। বাংলালিংক করেছি।
তো সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনার জ্ঞান কী হবে?
জ্ঞান তো আর হারিয়ে যাবে না। আমি যা শিখেছি, যা জেনেছি, তা আমাকে নিশ্চয়ই পথ দেখাবে। তাই না? তবে আমি আপাতত ফ্যামিলিকেই সময় দেব ঠিক করে রেখেছি।
ডায়েট করেন?
না, সেইভাবে না। তবে ওয়ার্কআউট করি। জিম করি। ইয়োগার প্রশিক্ষক আসতেন। আমার আর সাকিবের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে, কে বেশি ফিট থাকতে পারি। আসলে ওজন কমানোর জন্য না, সুস্থ থাকার জন্য ফিট থাকার জন্য চেষ্টা করি।
সাকিবের একটা ভালো গুণ বলেন।
ও খুব মাথাঠান্ডা মানুষ। সবকিছু ঠান্ডা মাথায় নিতে পারে।
সাকিব খুব রাগী না?
না–না। বিয়ের পরে রাগ পানি হয়ে গেছে। শোনেন, হুমায়ূন আহমেদের একটা কথা আছে, যার বাইরেরটা শক্ত, তার ভেতরেরটা নরম। সাকিব কাউকেই কখনো ব্যথা দিতে পারে না। হি ইজ রেসপেক্টফুল অ্যান্ড লাভিং।
সাকিবের দোষ?
ব্যস্ত মানুষ। খেলা থাকলে তো আর ফ্যামিলিকে সময় দিতে পারে না।
শিশিরের গুণ?
সবকিছু ভেবেচিন্তে করি।
বিয়েটাও কি ভেবেচিন্তে?
আরে বিয়ে তো হয়ে যায়। আপনি আপনার ওয়াইফকে পেয়ে গেলেন। বুঝলেন এই আমার সেই...বিয়ে করার জন্য ভাবতে হবে কেন।
শিশিরের একটা খুঁত ধরুন।
ভীষণ রাগী। মাথা গরম করে ফেলি। তখনই ভুল হয়ে যায়।
এত বড় তারকার সঙ্গে সংসার করার সুবিধার দিক কী আর অসুবিধার দিক কী?
মানুষ ওকে ভালোবাসে। সাধারণ মানুষ। রাস্তার ফুলওয়ালা মেয়েরা। রিকশাওয়ালা আঙ্কেলরা। ওরা কিন্তু সেলফি তুলতে চায় না। একটু দেখা হলো, খুশি। বলে যে সাকিব আল হাসানকে দেখেছি, আজকের দিনটা ভালো যাবে। ওদের ওই কথাতে ওদের দিন ভালো যায় কি না জানি না, আমাদের সারাটা দিন খুব ভালো যায়।
লেখক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক, কবি ও কথাসাহিত্যিক