ফিলিপ আলফঁনসির বাংলাদেশ অভিযান

মূল রচনা: একাত্তর এখনো জীবন্ত তাঁর ভিডিও প্রতিবেদনে। পড়ুন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ফ্রান্সের এক বর্ষীয়ান টিভি সাংবাদিকের অনন্য অভিজ্ঞতার কথা

ফিরে দেখা ১৯৭১, বাংলাদেশের একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রামে তরুণ ফরাসি সাংবাদিক ফিলিপ আলফঁনসি
ফিরে দেখা ১৯৭১, বাংলাদেশের একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রামে তরুণ ফরাসি সাংবাদিক ফিলিপ আলফঁনসি

‘আপনার পাসপোর্টে মুক্তিযোদ্ধাদের সিল দেওয়ার ঘটনাটা কি আরেকবার বলবেন?
‘শুনেছি, একটা আলু কেটে বানানো হয়েছিল সেই সিলটা।’

মুক্তিযোদ্ধাদের সিলসহ সেই পাসপোর্ট
মুক্তিযোদ্ধাদের সিলসহ সেই পাসপোর্ট

ফিলিপ আলফঁনসিকে নাগালে পেতেই প্রথম প্রশ্ন। ফ্রান্সের নামজাদা এই সাংবাদিক ও প্রযোজক ইংরেজি জানেন না। অথবা যেটুকু জানেন, সেটা ব্যবহার করতে চান না। তিনি উত্তর দিলেন চোস্ত ফরাসিতে। আমাদের ভাষার সমস্যা সমাধান করতে দোভাষীর দায়িত্বটা নিলেন তথ্যচিত্র নির্মাতা প্রকাশ রায়।
‘হ্যাঁ, সেটা ছিল এপ্রিল মাস। আমি তখন কলকাতায়। শরণার্থীদের পথ ধরে আমি যাচ্ছিলাম। প্রথম যে জায়গাটায় রিপোর্ট করতে গিয়েছিলাম, সেটা ছিল চুয়াডাঙ্গার একটি জায়গা। ওই জায়গায় কিছু সময় আগে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। এক দল মুক্তিযোদ্ধা আমাকে বললেন, বাংলাদেশে ঢুকতে হলে পাসপোর্টে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিসা লাগবে। তাঁরা আমার পাসপোর্টে সত্যি সত্যি একটা সিল দিয়ে দিলেন। যতদূর মনে পড়ে, একটা আলু কেটে সেই সিলটা বানানো হয়েছিল।’

পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণের মুখে পালাচ্ছে মানুষ
পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণের মুখে পালাচ্ছে মানুষ

আলফঁনসির সেই পাসপোর্টের গল্পে আমরা আবার ফিরে আসব। তার আগে চলুন ফিরে যাই আলফঁনসির ক্যারিয়ারের শুরুতে। ১৯৭১ সালে তরুণ সাংবাদিক আলফঁনসি কাজ করছিলেন ফ্রান্সের একমাত্র টিভি চ্যানেলে। টিভি চ্যানেলটির পুরোভাগে ছিলেন ফ্রান্সের টিভি সাংবাদিকতার ইতিহাসে খ্যাতিমান দুই নাম—পিয়ের দেসগ্রপস ও পিঁয়ের দুমত। পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পাঠানোর জন্য আলফঁনসিকে বেছে নেওয়ার কারণ ছিল তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার বছর দেড়েক আগে একবার এই ভূখণ্ডে এসেছিলেন আলফঁনসি।
‘আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মানে যেটাকে পাকিস্তানিরা স্রেফ “বিদ্রোহ” বলে প্রচার করছিল, সেটা আসলেই জনযুদ্ধ কি না। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ আসলেই পাকিস্তানিদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে কি না সেটা দেখা।’
আলফঁনসি কী দেখেছিলেন? উত্তর মিলবে তাঁর সেই সময়ে ধারণকৃত ভিডিওচিত্রগুলো থেকে, যেখানে শুরুতেই আমরা দেখি, বিকট শব্দে একের পর এক উড়ে যাচ্ছে বোমারু বিমান। মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। একাত্তর সেখানে পুরোপুরি হাজির।
মুক্তিযুদ্ধের এসব দুর্লভ ভিডিওচিত্র হয়তো আমাদের অদেখাই থেকে যেত। কিন্তু...

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রশিক্ষণ শিবির
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রশিক্ষণ শিবির

একটি পতাকার জন্ম
বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলের ছেলে প্রকাশ রায়। তিনি নাটক করেন, থিয়েটার করেন। কাজ করেছেন তারেক মাসুদ পরিচালিত অন্তর্যাত্রা ছবিতেও।
২০০৪ সালে প্রকাশ চলে যান প্যারিস। সেখানে গিয়ে নাম লেখান নাটকের দলে। চলচ্চিত্রবিষয়ক কোর্সের অংশ হিসেবে তিনি তৈরি করেন তাঁর প্রথম তথ্যচিত্র অনিশ্চিত যাত্রা। সেই ছবির কাজ করতে গিয়েই প্রকাশ সন্ধান পান এক অমূল্য ‘স্বর্ণখনি’র। ১৯৭১ সালে ফরাসি সাংবাদিকদের ধারণ করা প্রায় দুই ঘণ্টার ভিডিওচিত্র! প্রথম দেখাতেই প্রকাশ বুঝেছিলেন, এই ভিডিওচিত্র বাংলাদেশে অদেখা। সেটা পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হককে ওগুলোর অংশবিশেষ দেখানোর পর।

রণাঙ্গনে মুক্তিসেনা
রণাঙ্গনে মুক্তিসেনা

প্রকাশ ঠিক করলেন, যে করেই হোক এই ভিডিওচিত্র তাঁকে পেতেই হবে। কিন্তু সেগুলো রক্ষিত আছে ফ্রান্সের জাতীয় মহাফেজখানায়। নিজে দেখার জন্য ভিডিওগুলোর অংশবিশেষ পাওয়া যায় বটে, কিন্তু অনুমতি ছাড়া সেগুলো চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা অসম্ভব। আর এগুলো চলচ্চিত্রে ব্যবহারের জন্য চাই বিপুল অঙ্কের ফি। সেই অঙ্কটা প্রকাশের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
‘একবার ভেবেছিলাম, আমার যা হয় হোক, ভিডিওগুলো আমি আমার ছবিতে ব্যবহার করবই। ওগুলো বাংলাদেশের মানুষকে দেখানোর জন্য আমাকে যদি জেলে যেতে হয়, তা-ও যাব।’ প্রকাশ বলছিলেন।
শেষ পর্যন্ত প্রকাশ রায় কী করতেন কে জানে। তবে তাঁকে জেলে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে হয়নি, কারণ কাজী এনায়েত উল্লাহ্। ফ্রান্স-বাংলাদেশ ইকোনমিক চেম্বারের সভাপতি তিনি। কাজী এনায়েত উল্লাহ্ এগিয়ে এলেন বাংলাদেশের অদেখা সেই দুর্লভ ভিডিওচিত্র উদ্ধারকাজে। শামিল হলেন এক নির্মাতার স্বপ্নপূরণের লড়াইয়ে। সেই ভিডিওচিত্রগুলো ব্যবহারের অনুমতি মিলল। কিন্তু কে হবেন বাংলাদেশ: একটি পতাকার জন্ম নামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তথ্যচিত্রটির ‘নায়ক’। অবশ্যই ফ্রান্সের সেসব সাংবাদিকদের একজন, যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে এসেছিলেন আমাদের এই ভূখণ্ডে।
প্রকাশ খুঁজলেন তাঁদের। অ্যালেন কঁসেসের নাম পাওয়া গেল। কিন্তু ভদ্রলোক জীবিত নেই। শেষ পর্যন্ত খোঁজ মিলল ফিলিপ আলফঁনসির।
অতঃপর আলফঁনসি আর বাংলাদেশ: একটি পতাকার জন্ম নামের চলচ্চিত্রকে বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পালা।

ঢাকায় ফিলিপ আলফঁনসির সঙ্গে প্যারিসপ্রবাসী নির্মাতা প্রকাশ রায়, ছবি: কবীর শাহরীয়ার
ঢাকায় ফিলিপ আলফঁনসির সঙ্গে প্যারিসপ্রবাসী নির্মাতা প্রকাশ রায়, ছবি: কবীর শাহরীয়ার

জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি, জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে হাজির বহু সুধীজন। খানিক পরেই শুরু হবে বাংলাদেশ: একটি পতাকার জন্ম তথ্যচিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনী। অতিথিরা মঞ্চে আসীন। মফিদুল হক পরিচয় করিয়ে দিলেন একজন ভিনদেশিকে। বয়স তাঁকে কাবু করতে পারেনি মোটেও। হলিউড অভিনেতা মাইকেল ডগলাসের স্টাইলে পেছনে আঁচড়ানো চুল। আপাদমস্তক ফ্যাশন-সচেতন একজন মানুষ। হ্যাঁ, তিনিই ফিলিপ আলফঁনসি। ছবি শুরুর আগ মুহূর্তে মাইক্রোফোনের সামনে এলেন এই ফরাসি। মিলনায়তনভর্তি মন্ত্রমুগ্ধ দর্শক শুনলেন এক ভিনদেশির বাংলাদেশ অভিযানের কাহিনি। খানিক পরেই পর্দা উঠল ছবির। সাদা-কালো ভিডিওচিত্রে খুব সহজে খুঁজে পাওয়া গেল তরুণ আলফঁনসিকে।
‘সামরিক শক্তির দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে ছিল পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ছিল খুব দৃঢ। স্বভাবে তাঁরা ছিলেন শান্ত। যথেষ্ট শৃঙ্খলাও ছিল তাঁদের মধ্যে। তাঁদের দেখেছি সাধারণ মানুষজনকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়ার কাজ করছিলেন। সাধারণ মানুষজনও পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল তাঁদের।’
সেই দফায় ১৫ কি ২০ দিন আলফঁনসি ছিলেন বাংলাদেশে। ‘আমি যখন প্রতিবেদন সংগ্রহের পর কলকাতায় ফিরে যাই, তখন দেখি, অনেক সাংবাদিক সেখানে অপেক্ষমাণ। তাঁরা আমাকে রীতিমতো ছেঁকে ধরেছিলেন।’ বলছিলেন আলফঁনসি। তাঁর সেসব সাহসী প্রতিবেদন টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার পর বিপুল সাড়া পড়ে যায় ফ্রান্সে।

সেই আর এই বাংলাদেশ
‘যতদূর মনে পড়ে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষের খুব পরিষ্কার ধারণা ছিল না। আমার প্রতিবেদনগুলো প্রচারের পর পাকিস্তানিদের বর্বরতা সবাই জানতে পারে। বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে তখন বড় ধরনের জনমত তৈরি হয়।’ মন্তব্য আলফঁনসির।
এবারে আলাপ পর্বের স্থান প্যানপ্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁও। সময় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল চারটা।
আলফঁনসিকে আরেকটা প্রশ্ন, এত বছর পর বাংলাদেশকে আবার দেখলেন খুব কাছ থেকে। একাত্তর আর এখনকার বাংলাদেশের মধ্যে কোনো তফাত কি চোখে পড়ে?
আলফঁনসির ধূসর চোখ জোড়া নিশ্চল হয়ে রইল খানিক। কী যেন ভাবলেন, তারপর মুখ খুললেন সম্ভবত ভেবেচিন্তে।
‘আসলে এই অল্প দেখায় খুব বড় কিছু বলা অসম্ভব। তবে সেদিন গ্রামের দিকে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। মনে হলো, গ্রামগুলো ঠিক আগের মতোই আছে। কিন্তু ঢাকায় বড় বড় অনেক বিল্ডিং উঠে গেছে...’
বলতে বলতে আবার কী যেন ভাবেন আলফঁনসি।
হোটেল সোনারগাঁও থেকে আলাপ শেষে চলে আসব। বাংলাদেশের এই দুর্দিনের বন্ধুকে বলি, ‘একদিন আমাদের প্রথম আলো অফিসে আসুন। সবাই মিলে আমরা আপনার কথা শুনব। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক প্রকাশনাও আছে আমাদের। আসবেন?’
শুনেই হেসে উঠলেন আলফঁনসি। ‘আমি তো কাল চলে যাচ্ছি। তবে যেতে পারলে ভালো লাগতই।’
সে কারণেই বলতে হলো, এবারের মতো বিদায় হে ভিনদেশি বন্ধু।
আর হ্যাঁ, ওই যে মুক্তিযোদ্ধাদের সিল দেওয়া পাসপোর্ট, সেটা এখনো আছে আলফঁনসির সংগ্রহে। সেই পাসপোর্ট বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কাছে তুলে দেওয়ার ইচ্ছে এই ফরাসি সাংবাদিকের। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তারা এই পাসপোর্ট দেখবে। হয়তো ভাববে, সত্যসন্ধানী এক ফরাসি সাংবাদিক কী দুঃসাহসী একটা কাজই না করে গেছেন বাংলাদেশের জন্য!