হাল ছাড়িনি কখনো

>
রামি মালেক
রামি মালেক
হলিউড অভিনেতা রামি মালেক তাঁর জীবনের প্রথম অস্কার জিতলেন গত রোববার। এর মধ্য দিয়ে মিসরীয় বংশোদ্ভূত প্রথম অস্কারজয়ী অভিনেতার রেকর্ডটি করে নিলেন নিজের দখলে। বোহিমিয়ান র‌্যাপসোডি ছবিতে ‘কুইন’ ব্যান্ড খ্যাত সংগীত কিংবদন্তি ফ্রেডি মার্কারির চরিত্রে দেখা গেছে তাঁকে। অস্কারের আগে এ বছরের গোল্ডেন গ্লোব, স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ডও গেছে তাঁর হাতে। অভিবাসী পরিবারের সন্তান হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা ও আর্থিকভাবে সচ্ছল জীবনের খোঁজ করতে করতে বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়ে যাওয়া এই অভিনেতার কিছু কথা থাকছে এই লেখায়—

আমার বোনের জন্ম মিসরে। আর আমার ও আমার যমজ ভাইয়ের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। এই দেশে আসার পর থেকে আমার মা-বাবাকে আমাদের জন্য একটি নিরাপদ সচ্ছল জীবন নিশ্চিত করতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। কারণ, একজন অভিবাসীর জীবন কখনো কোনো সময়ই সহজ ছিল না। আমার বাবা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিমা বিক্রি করতেন। আর মা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আমাদের যমজ দুই ভাইকে গর্ভে নিয়েই খুব অল্প বেতনে ছোট ছোট কাজ করতেন। প্রতিদিন তিনটি বাস বদলে তাঁকে তাঁর কাজের জায়গায় যেতে হতো। এসব তাঁরা করতেন শুধুই আমাদের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দেওয়ার জন্য। আমার বোন আজ একজন চিকিৎসক, আমার ভাই শিক্ষক আর আমি আজ এই অবস্থানে পৌঁছেছি। আমার মনে হয়, আমি গুটিকয়েক সৌভাগ্যবানদের একজন। কারণ, এমন জীবনের প্রত্যাশা অনেকেই করেন, কিন্তু সবাই এই সংগ্রাম-বাধা পেরিয়ে এ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না।

আমার মনে আছে, গ্র্যাজুয়েশন করার পর একটা কাজ পাওয়ার জন্য আমাকে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে। সেই গল্পটা অনেক হতাশা, অবসাদ আর প্রতিকূলতায় ভরা। ছোটবেলায় মাত্র ১৩ বছর বয়সেই আমি আমার ভেতরের অভিনয়ের প্রতি টান থাকার ব্যাপারটা বুঝতে পারি। আমি যে কাউকে দেখেই তার অনুকরণ করতে পারতাম। টিভি দেখে দেখে প্রিয় সিনেমার দৃশ্যগুলো আয়নার সামনে আওড়াতাম। আমার মা-বাবা অভিবাসী হিসেবে কায়রো থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস এসেছিলেন একটা নিরাপদ ও উন্নত জীবনের আশায়। তাই আমাদের বেলাতেও তাঁরা চাইতেন, যেন পড়াশোনা করে আমরা আর্থিকভাবে নিরাপদ কোনো পেশা বেছে নিই। যেমন আইনজীবী, চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলীর। কিন্তু হাইস্কুল থেকেই আমার মন কেন যেন ওদিকে টানত না। আমি মনকে একটু স্বস্তি দেওয়ার জন্য তাই নিয়মিত পাঠ্য বিষয়গুলোর পাশাপাশি ‘সাবস্টিটিউট’ হিসেবে ‘বেকিং’ ক্লাস শুরু করি। সেখানেও আমার মন টিকছিল না। কিন্তু একদিন বেকিং শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে আরেকজন আসেন ক্লাস নিতে। তিনি ছিলেন ব্যারি লেস্টার নামের একজন শিক্ষক। মূলত তিনি কৌতুক অভিনেতা ছিলেন। ক্লাসে তিনি আমাকে দেখেই বুঝতে পারেন আর বলেন, ‘তোমার তো এখানে থাকার কথা না!’ তিনিই আমাকে অভিনয়ের ক্লাসে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর থেকেই আমি ধীরে ধীরে আমার ভেতরের আকাঙ্ক্ষাকে বুঝতে শুরু করি। সামাজিক আর আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করার জন্য আমার মা-বাবা প্রথমে ফাইন আর্টস নিয়ে পড়াশোনার ব্যাপারে আমাকে নিরুৎসাহিত করতেন। কিন্তু আমি ছিলাম পরিবারের সবচেয়ে একরোখা আর জেদি সদস্য। আমি ফাইন আর্টসে থিয়েটার বিষয় নিয়েই আমার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করি। এরপর শুরু করি বিভিন্ন জায়গায় আমার বায়োডাটা আর ছবি পাঠানো। খুব কঠিন ছিল সেই দিনগুলো। টানা এক বছর আমি শুধু বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, টিভি চ্যানেল, ফিল্ম স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছবি ও বায়োডাটা পাঠিয়েই গেছি। কিন্তু কোথাও থেকে কাজের জন্য ডাক আসেনি।

আমি মা-বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে লস অ্যাঞ্জেলেসের একটা দুই রুমের অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম। আমি ঘুমাতাম সোফার পাশে মাটিতে বিছানা করে। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙেই আমি চিঠির বাক্সটা নিয়ে বসতাম, দেখার জন্য যে কোনো জায়গা থেকে অভিনয়ের ডাক এসেছে কি না। বাবা নাশতার টেবিলে বসে আমার মাকে বলতেন, ‘এই ছেলে কী হাল ছাড়বে না?’ বাবার সেই প্রশ্নে একধরনের স্বস্তি অনুভব করতাম আমি। সেই সময়টায় নিজের খরচ চালানোর জন্য আমি লস অ্যাঞ্জেলেসের হলিউডের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট-হোটেলে শর্মা আর ফালাফেল স্যান্ডউইচ বানানোর কাজ করতাম। সেখান থেকে পাওয়া বেতন দিয়ে ছবি তুলতাম আর আবারও সেগুলো পাঠাতাম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আর বিভিন্ন স্টুডিওতে। হতাশ লাগত, ক্লান্ত লাগত, কিন্তু হাল ছাড়িনি কখনো।

টানা বায়োডাটা পাঠানোর দেড় বছর পর আমার কাছে একটা ফোন আসে। সেটা ছিল কাস্টিং এজেন্ট মারা ক্যাসির। ফোন দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি কি রামি মালেকের এজেন্টের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’ ফোনের এ পাশ থেকে আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম, ‘বলছি।’ তখনই তিনি বললেন সেই কাঙ্ক্ষিত কথাগুলো, যেটা শোনার জন্য দেড় বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম! তিনি বললেন, ‘রামির কি সময় হবে আমাদের “গ্ল্যামার গার্ল” সিরিজের একটি ছোট চরিত্রের জন্য অডিশন দেওয়ার? সে কি এই মুহূর্তে জানাতে পারবে, তার সময় আছে কি না?’ আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে জানিয়ে দিই, ‘হ্যাঁ, সময় আছে।’ মারা তখন বলেন, ‘আপনি তাঁকে আগে জিজ্ঞেস করে দেখুন, এরপর আমাকে জানান।’ আমি তখন সত্যিটা বলে দিই যে আমার কোনো এজেন্ট নেই। আমি নিজেই নিজের জন্য কাজ খুঁজছি। তখন মারা জানান, হলিউডে নাকি এভাবে কাজ হয় না। প্রত্যেক শিল্পীর একজন এজেন্ট বা প্রতিনিধি লাগে। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার এজেন্টের খরচ চালানোর মতো আর্থিক অবস্থা ছিল না। আবার আমি দেড় বছর পর পাওয়া সুযোগটাও হারাতে চাইছিলাম না। তাই আমি তখন তাঁকে বলি, ‘দেখেন, আপনি নিশ্চয়ই আমার বায়োডাটায় এমন কিছু দেখেছেন, যা আপনাকে সত্যিই খুব আকৃষ্ট করেছে। এখন একজন এজেন্ট না থাকার কারণে সেই আকর্ষণকে আপনি গুরুত্ব দিতে চাইছেন না? একবার আমাকে আমার কাজ দেখানোর সুযোগ দিন। আপনি ফোনে যেই কথাটা বলছেন, সেটা অন্তত আমাকে সামনাসামনি শোনার সুযোগ দিন।’ মারা ক্যাসি সেদিন আমার আগ্রহ আর ব্যাকুলতা হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন। আমাকে তিনি তাঁদের অফিসে ডাকলেন, আর আমি আমার জীবনের প্রথম টিভি শোয়ের কাজটা পেয়ে যাই। সেটা ছিল ২০০৪ সাল। সেই বছর ছোট ছোট বেশ কিছু কাজ করি। সেই কাজগুলোর মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে শুরু করি, যা আমি পিৎজা ডেলিভারি করতে গিয়ে, শর্মার দোকানের কাজ করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছিলাম। হতাশার সময়টায় আমার বারবার মনে হতো—আমার কাছে ডিগ্রি আছে, সনদ আছে এরপরও কেন আমার দিন এমন যাচ্ছে! তবে এখন এই সময়ে এসে বুঝতে পারছি, আমার কোনো কাজই আসলে বিফলে যায়নি।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান
ইজিপ্ট ইন্ডিপেনডেন্ট, এসএজি-এফটিআরএ ফাউন্ডেশন ও ভালচার অবলম্বনে