স্বাধীন দিনের নুসরাত

ঢাকায় মোটরবাইক চালিয়ে মেয়েদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন নুসরাত। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
ঢাকায় মোটরবাইক চালিয়ে মেয়েদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন নুসরাত। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

‘আপনার নাম নুসরাত, দিন ভালো লাগে নাকি রাত?’

১৮ বছর বয়সী এই তরুণী মেপে হাসেন না। প্রশ্ন শুনে হো হো করে একচোট হেসে নিলেন। বললেন, ‘আমার সবই ভালো লাগে। দিন–রাত, সকাল–সন্ধ্যা—সব।’

এই দিনরাত্রি বেশ উপভোগ করছেন নুসরাত। খুব ছোটবেলা থেকে অবচেতনে ‘স্বাধীনতা’ ব্যাপারটি ভালোবেসে ফেলেছেন। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদির ভিটিপাড়া গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন একরকম যুদ্ধ করেই। যুদ্ধটা ওই স্বাধীনতার জন্যই। ঢাকার দিনকাল যখন উপভোগ করছেন, তখন বুঝতেই পারছেন, নুসরাত কিছুটা হলেও প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারছেন। ঢাকার বাতাস দূষিত, তারপরও নুসরাত তাঁর পরিকল্পনায় অটল, ‘ঢাকা ছেড়ে আমি আর কোথাও যাব না।’

কেন যাবেন না? নুসরাত লম্বা একটা টান দিয়ে বললেন, ‘সে অনেএএক কথা!’

‘অনেএএক কথা’র আগে ঢাকার কথা শুনতে চাই। নুসরাত এখন মোটরসাইকেল চালান ঢাকা শহরে। ‘ও বোন’ নামের মোবাইল অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা প্রতিষ্ঠানের হয়ে ঢাকার রাস্তায় ছুটে বেড়ান সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। স্কুটি নয়, সুজুকি হায়াট মোটরসাইকেলের পেছনে নারী যাত্রীদের নিয়ে পৌঁছে দেন গন্তব্যে। অথচ তাঁর নিজের গন্তব্য ঠিক করতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। মা আনোয়ারা গৃহিণী, বাবা নুরুল ইসলাম কৃষক। নুসরাতের যমজ বোন আমেনা। নুসরাতের ভাষায়, ‘আমাদের ভাই ছিল না বলে এলাকার কিছু মানুষ সব সময় পেছনে লেগে থাকত। আমার বোনটা ভয়ে ঘরের ভেতরেই থাকত। কিন্তু আমি ছিলাম পুরোপুরি উল্টো।’

উল্টো ছিলেন বলেই চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় সাইকেল চালাতে শিখেছিলেন। নবম শ্রেণিতে থাকতে চাচাত ভাই ও বন্ধুদের কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলেন মোটরসাইকেল চালানো। আর শিখেছিলেন ক্রিকেট মাঠে দ্রুত গতিতে বল ছুড়তে। ছেলেদের সঙ্গেই ক্রিকেট খেলতেন নুসরাত। তাঁর কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস সমীহ জাগায়, ‘আমি বেশ ভালোই বল করি। ব্যাটিংটাও খারাপ করি না। আর টিভিতে মেয়েদের খেলা দেখতে দেখতে আমারও খুব ইচ্ছা করত, ক্রিকেটার হব।’

তাই এসএসসি পরীক্ষার পর মা–বাবাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ঢাকায় চলে এলেন নুসরাত। একদম একা। গত বছরের কথা সেটা। কিছু না জেনেই সোজা চলে গেলেন ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে। সেখানে একে–ওকে জিজ্ঞেস করে চলে গেলেন তেজগাঁওয়ের খেলাঘর একাডেমিতে। ভর্তি হলেন। থাকতে শুরু করলেন ধানমন্ডিতে। বাবার পাঠানো টাকায় থাকা–খাওয়া–খেলাধুলা চলতে লাগল। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? একসময় উপলব্ধি করলেন, ক্রিকেট খেলে সহসাই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়।

অসম্ভবকে সম্ভব করল ফেসবুক। স্ক্রল করতে করতে একদিন পেয়ে গেলেন ‘ও বোন’–এর চাকরির বিজ্ঞপ্তি। সোজা চলে গেলেন পরীক্ষা দিতে। নুসরাতের কাছে মোটরসাইকেল মানে পঙ্খীরাজ। ফলে চাকরি পেয়ে গেলেন সেদিনই। কিন্তু ফোন করে, ‘চাকরিটি আমি পেয়ে গেছি বাবা শুনছ’ বলতে পারলেন না। কারণ, বাড়িতে শুনলে নির্ঘাত নিষেধাজ্ঞা নেমে আসত। নুসরাত আর সে ঝুঁকি নিলেন না। ৮ মাস আগে চাকরি শুরুর প্রথম দিন ধানমন্ডি থেকে এক নারী যাত্রীকে পৌঁছে দিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। নারী যাত্রী মোটরসাইকেল থেকে নেমেই অলিখিত প্রশংসাপত্র দিয়ে দিলেন, ‘আপনার চেয়ে ভালো আর কেউ চালায় না!’

কেমন লাগে এই প্রশংসা? নুসরাত আবার হাসেন, ‘ভালোই তো লাগে। আসলে রাস্তায় তো মেয়েদের অনেক সমস্যা। তাই মেয়ে চালক পেলে সবাই খুশি হয়। নিশ্চিন্তে যাত্রা করতে পারে।’

আপনার কোনো সমস্যা হয় না? ‘বাড়িতে যখন ছিলাম, তখন থেকেই তো এসব দেখে আসছি। আমি খুব রাগী মানুষ। কোনোদিনই এসব পাত্তা দিই নাই। কোনো ছেলে বেয়াদবি করতে এলে সোজা সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। এখন ঢাকার রাস্তায় মাঝেমধ্যে কেউ কেউ ইচ্ছে করে মোটরসাইকেল লাগিয়ে দেয়। আমি কাউকে ছেড়ে কথা বলি না। নিজে না দাঁড়ালে বাকি মেয়েদের সঙ্গেও ওরা একই আচরণ করে যাবে।’ বললেন নুসরাত।

কিন্তু জীবনে অনেক কিছুতেই ছাড় দিতে বাধ্য হচ্ছেন নুসরাত। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ছিল, সেটা আপাতত ফিকে হয়ে এসেছে। ফটোসাংবাদিকতা তাঁর নতুন আরেক স্বপ্ন। বাড়িতে মা–বাবা অবশ্য এখন তাঁর চাকরির খবর জানেন। মেনেও নিয়েছেন। এ কারণেই ঢাকা নুসরাতের প্রিয় শহর। ঢাকা তাঁকে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা দিয়েছে। আর কতদিন মোটরসাইকেল চালাবেন, তা জানেন না। কিন্তু এটা ঠিকই জানেন, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যা করা দরকার ঠিক তা–ই করবেন।