চাকরিটা ছেড়েই দিলাম...

অঙ্কন: আরাফাত করিম
অঙ্কন: আরাফাত করিম

‘চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার পর ছয় মাস পর্যন্ত প্রচণ্ড বিষণ্নতায় ভুগতাম। মনে হতো আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলেছি।’ আট বছর চাকরি করেছিলেন ফারজানা রহমান। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন চার বছরের বেশি হয়ে গেল। এখনো সেই সময়ের জন্য মন কেমন করে ওঠে। চাকরিটা ছাড়লেন কেন? এই কয় বছরে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি অনেকবারই হতে হয়েছে ফারজানাকে। বললেন, ‘কোনো উপায় ছিল না। দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের পর চাকরিটা ছাড়তেই হলো।’

সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে তিনজন উচ্চশিক্ষিত মায়ের কথা হলো, যাঁরা ভালো বেতনের চাকরি করতেন। তিনজনই প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে টেনেটুনে জোড়াতালি দিয়ে চাকরি অব্যাহত রাখতে পারলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় সন্তান জন্মের পর প্রতিবন্ধকতা আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ছেড়ে আসা সেই চাকরির জন্য ‘মন কেমন করা বেদনা’ নিয়েই তাঁরা দিন কাটান। কখনো কোনো আড্ডায় উঠে আসে তাঁদের ফেলে আসা কর্মব্যস্ত চাকরিজীবনের কথা। চাকরিজীবী কোনো নারীকে দেখলে সেই স্মৃতি বেশ জোরেই ধাক্কা দেয়।

উচ্চশিক্ষিত নারীদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা নিয়ে ২০০৫ সালের গবেষণা প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ বলছে, কোনো না কোনো কারণে উচ্চশিক্ষিত ১০ জন নারীর ৪ জন স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন। এ সংখ্যা ৩৭ শতাংশ। আর উচ্চশিক্ষিত মায়েদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার হার আরও বেশি, ৪৩ শতাংশ। এই নারীদের ‘স্যান্ডউইচ’ প্রজন্ম বলে থাকেন অনেকে। কারণ, তাঁরা বয়স্ক মা–বাবা ও বড় হতে থাকা সন্তানের মধ্যে আটকা পড়েন। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছেন বা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, এমন শিক্ষিত নারীদের সবার একটি বিষয়ে মিল রয়েছে, তা হলো পারিবারিক সচ্ছলতা। স্বামীর আয় যথেষ্ট নয়, এমন নারীরা চাকরি ছাড়েননি। চাকরি ছেড়ে দেওয়া ৩২ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তাঁদের স্বামীর উপার্জন একা সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্য বলছে, বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা গত কয়েক বছরে কমেছে। ২০১৬ সালে প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি অর্থাৎ বেতনভুক্ত নারী কর্মজীবীর সংখ্যা ৩৬ শতাংশ থেকে কমে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম আমানউল্লাহর মতে, শহরে যৌথ পরিবারব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সন্তান আছে—এমন নারীরা চাকরি করার ক্ষেত্রে পরিবার থেকে সহায়তা পান না। দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি হওয়ায় কোনো নারীর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না।

চাকরি ছেড়ে দেওয়াই ছিল ভালো সমাধান
চাঁদপুরের মতলব উপজেলায় রয়মনেন নেছা মহিলা ডিগ্রি কলেজে বাংলা বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ছিলেন নার্গিস সুলতানা। স্বামী ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দুই মেয়ে নিয়ে নার্গিস কলেজের কাছে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। এর পর স্বামীর কর্মস্থল মালয়েশিয়ায় চলে যেতে হয়। দেশে ফিরে ২০১২ সালে আবার কলেজে যোগ দেন। ঢাকা থেকে গিয়ে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। মধ্যে অনিয়মিত হওয়ায় পদোন্নতিসহ বিভিন্ন বিভাগীয় বিষয়ে পিছিয়ে পড়তে লাগলেন। এরপর তৃতীয়বার গর্ভধারণ করার পর সবকিছু সামলানো কঠিন হয়ে পড়ল। ২০১৪ সালে কর্মজীবনে ইস্তফা দিলেন।

নার্গিস বলছিলেন, কখনো নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেন যে সন্তানের দেখভালের জন্য চাকরি ছেড়ে ভালোই করেছেন। আবার কখনো হতাশা এসে ভর করে। আগের মতো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তো নেই। মনে মনে ভাবেন, তাঁর তিন মেয়েকে যেন কোনো অবস্থাতেই চাকরি ছাড়তে না হয়।

জগন্নাথ কলেজ থেকে প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে মাস্টার্স করা ফারজানা রহমান ছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপে এস্টেট শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। ২০০৯ সালে বড় ছেলের জন্ম। বাসায় কাজের সহকারী সব সামলে রাখতেন। মা তো ছিলেনই। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের সময় বাসার সহকারী চলে যান। মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তো আর ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করলে চলে না।

ফারজানা রহমান বলেন, ‘চাকরি ছাড়ার পর ছয় মাস পর্যন্ত বিষণ্নতায় ভুগতাম। আগে কোথাও গেলে নিজের পরিচয় দিতাম একটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে। এখন মনে হয় আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলেছি। বাসার কাজে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকি, কিন্তু এ কাজের তো কোনো স্বীকৃতি নেই কোথাও।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টার্স করা লুবনা মহসিন ২০০৬ সালে চাকরিতে যোগ দেন। ২০১৪ সালে চাকরি ছাড়ার সময় তিনি গ্রামীণ ফোনের মানবসম্পদ বিভাগে জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর ভাষায়, তিনি সংসার, সন্তান আর চাকরি—এই তিন বিষয় একসঙ্গে ‘ম্যানেজ’ করতে পারছিলেন না।

নারীদের চাকরি ছাড়ার বিষয়টি গুরুত্বও পায় না
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম আমানউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে নারীদের চাকরি করার বিষয়টি এখনো বেশির ভাগ পরিবারে সমাদৃত নয়। শহরে মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরাই এ অবস্থার শিকার হন। গ্রামীণ নারীরা বাড়িতে থেকে অর্থ উপার্জন করেন বলে পারিবারিকভাবে বাধার শিকার হন না।

অধ্যাপক আমানউল্লাহর মতে, শহরে যৌথ পরিবারের সংখ্যা ১০ শতাংশের কম। সন্তান দেখভালের জন্য কাউকে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কর্মজীবী মা সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে কর্মস্থলে যাবেন, সেই সুবিধাও নেই। শহরাঞ্চলে সন্তান দেখভাল করা নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়, তাতে নারীর চাকরি ছাড়ার মধ্য দিয়ে সমস্যার সহজ সমাধান করা হয়। এই একই কারণে পুরুষ চাকরি ছেড়েছে, তার নজির নেই বললেই চলে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সবশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশিত তথ্য বলছে, দেশে মোট ৬ কোটি ৬৬ লাখ কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ২ কোটি ৯১ লাখ নারী।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা সহযোগী মো. ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৩৬ শতাংশেই আটকে আছে। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে নারীর অংশগ্রহণ শহরে কমে ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং গ্রামে বেড়ে ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। ফলে গ্রামে অংশগ্রহণ বাড়ায় জাতীয় পর্যায়ে মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ গড়ে ওই ৩৬ শতাংশই রয়েছে। এখানে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বলতে বোঝানো হয় যে নারীরা কাজ করছেন এবং কাজ খুঁজছেন। চাকরি ছেড়ে দেওয়া নারীদের হিসাব আর কে রাখে?

শুধু লুবনা মহসিনদের মনের ভেতরে চলতে থাকে হাহাকার। লুবনা বলছিলেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গ্রামীণ ফোনের প্রধান দপ্তরের কাছেই তাঁর বাসা। প্রায়ই গ্রামীণ ফোনের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়, পথে পুরোনো সহকর্মীদের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। তখন মন খারাপ হয়।