শূন্য দশকের কিংবদন্তিরা

আমরা কিংবদন্তি গ্রুপের স্বাস্থ্যসেবা। ছবি: সংগৃহীত
আমরা কিংবদন্তি গ্রুপের স্বাস্থ্যসেবা। ছবি: সংগৃহীত

তরুণ মাসুদ রানার কিডনিতে নানা জটিলতা দেখা দেয় দেড় বছর আগে। পরিবারের যতটা সাধ্য ছিল, তা দিয়ে চিকিৎসা চলে। কিন্তু এতে সুস্থ হননি তিনি। চিকিৎসার টাকার খোঁজে যখন তিনি দিশেহারা তখন এগিয়ে এলেন তাঁর বয়সী কিছু তরুণ। চিকিৎসা আবার শুরু হলো। একা মাসুদ রানা পাশে পেলেন শত মাসুদ রানাকে। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৩ লাখের বেশি টাকা। সেই টাকা জোগাচ্ছেন মাসুদ রানার সেই বন্ধুরা। কারা এই বন্ধু?

শুরু ফেসবুক গ্রুপে
গল্পের শুরু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। নতুন শতকের শুরুতে ২০০০ সালে যাঁরা এসএসসি আর ২০০২ সালে এইচএসসি পাস করেছেন তাঁরা ফেসবুকে একটি গ্রুপ খোলেন ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর। এখানেই তাঁরা মাসুদ রানার খোঁজ পান। ফেসবুকের সেই গ্রুপে সাহায্যের জন্য পোস্ট দেওয়া হয়। পোস্টটিতে দারুণ সাড়া মেলে। এখন মাসুদ রানার চিকিৎসার খরচ তো চলছেই এমনকি আগামী এক বছরের খরচও জোগাড় হয়েছে। শুরুর গল্পটা এভাবেই বললেন, এই গ্রুপ চালুর উদ্যোক্তা নাজমুল হোসেন। এই গ্রুপের সদস্যসংখ্যা এখন ২১ হাজার।

আমরাই কিংবদন্তি!

২০০০ সালে যাঁরা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন তাঁরাই গ্রেডিং পদ্ধতির আগের শেষ ব্যাচ। অর্থাৎ তাঁদের ফলাফল হতো প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে। সেবার ফেল করলেই নতুন সিলেবাসে নতুন ব্যাচের সঙ্গে পরীক্ষা। ফলাফল নতুন গ্রেডিংয়ে। যেন বাঁচা-মরার লড়াই!

এই ব্যাচ তাই নিজেদের পরিচয় দিল ‘আমরাই কিংবদন্তি’ হিসেবে। ফেসবুকে গ্রুপের নামও তাই।

নতুন নতুন বন্ধুর দেখা

৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে ঢাকার মিরপুরে আড্ডার আয়োজন করে এই গ্রুপ। পুলিশের এক কর্মকর্তা এসে জানতে চান এত মানুষ একসঙ্গে কেন আড্ডা দিচ্ছেন? যখন পুলিশ কর্মকর্তা শুনলেন তাঁরা ২০০০ সালের ব্যাচ। পুলিশও হেসে দিয়ে বললেন, আরে ভাই, আমিও তো ওই ব্যাচের!

দানিয়াল ইসলাম যে বাসায় ভাড়া থাকতেন তার পাশেই থাকতেন এক চিকিৎসক শহিদুল ইসলাম। দুজন দুজনকেই একটু একটু করে চেনেন। হঠাৎ এক পোস্ট দেখে শহিদুল জানতে পারলেন দানিয়াল তাঁর ব্যাচের। এরপর বন্ধুত্ব গাঢ় হলো। এভাবে বন্ধু থেকে বন্ধু বাড়তে থাকল।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আছে শিশুরাও
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আছে শিশুরাও


অসহায়ের পাশে
দানিয়াল ইসলাম বলছিলেন, ‘গত বছরের কোরবানি ঈদের আগে আমরা কিছু একটা করব বলে ফেসবুকে পোস্ট দিলাম। সাড়া মিলল। অনেকে নগদ অর্থ পাঠালেন। এই টাকা দিয়ে ঢাকার মধুবাগের একটি এতিমখানায় গেলাম। সেখানে থাকা ২৪ জন এতিম শিশুকে নতুন পোশাক কিনে দেওয়া হলো। একই জায়গায় লুঙ্গি আর শাড়ি দেওয়া হলো অসহায় মানুষদের।’

গত বছররে ৩১ জানুয়ারি এই গ্রুপের সদস্য কাজী ইশতিয়াক নেওয়াজ এবং তাঁর বন্ধু নুরে সানি গভীর রাতে গেলেন বিমানবন্দর স্টেশনে। দেখলেন এক শিশু প্লাস্টিকের বোতল কুড়াচ্ছে। তারা শিশুকে জিজ্ঞেস করলেন কিছু খেয়েছে কি না। শিশুটি বলল, কিছু খায়নি। বাড়িতে বাবা-মাও কিছু খায়নি। তাৎক্ষণিক নিজেদের পকেটে যা ছিল তা দিয়ে তিনজনের খাবার কিনে দিলেন তাঁরা। চুপিচুপি সেই শিশুকে অনুসরণ করলেন। পরে দেখলেন বস্তিতে গিয়ে সে বাবা-মাসহ একসঙ্গে খাবার খাচ্ছে। এটি দেখে তাঁদের মন আনন্দে ভরে গেল। উৎসাহ পেলেন পথশিশুদের জন্য কিছু করার।

এরপর কমলাপুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, ফার্মগেট, সুপ্রিম কোর্ট এলাকার ১৮০ শিশুকে খাওয়ানোর উদ্যোগ নেন। এই খাবার কোনো দোকান থেকে নয়, খাবার উপকরণ কিনে বন্ধুরা মিলেই রান্না করেন। একই দিনে রংপুর, কুড়িগ্রাম, মাদারীপুর, চট্টগ্রামের বন্ধুরাও পথশিশুদের খাওয়ানোর আয়োজন করেন। সব মিলে ৪০০ পথ শিশুকে খাবার দেওয়া হয়।

গ্রুপের সদস্য ফিরোজ সালাউদ্দিন বলছিলেন, ‘গত বছর আমাদের গ্রুপে পোস্ট দিলাম, কুড়িগ্রামের শীতে কাতর মানুষের জন্য কাজ করব। এগিয়ে এলেন অনেকে।’ গাজীপুরের শ্রীপুরের জিএমএস নিটিং নামের একটি তৈরি পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাঁদের ডাকে সাড়া দেয়। সেখান থেকে ভালো মানের তিন হাজার জ্যাকেট নিয়ে তাঁরা গেলেন কুড়িগ্রামের উলিপুরে।

চিকিৎসাসেবা

এই দলটির সদস্যরা একসময় ভাবলেন এ দেশের অনেক মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। তাই তাঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গত বছরের নভেম্বরে নরসিংদীতে যাওয়ার কথা গ্রুপে জানালেন। এই পোস্টে সাড়া দিলেন গ্রুপে থাকা চিকিৎসক বন্ধুরা। চিকিৎসক বন্ধু শহিদুলসহ অন্যরা গেলেন নরসিংদীতে। সেখানে ৫০০ রোগীর চিকিৎসা দিলেন, ওষুধও কিনে দিলেন।

আমরা কিংবদন্তির সদস্যরা খোঁজ পেলেন মিরপুরের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড কেয়ার নামের বৃদ্ধাশ্রমের। গত জানুয়ারিতে সেখানে গেলেন তাঁদের একটি দল। কী সুবিধা থেকে বঞ্চিত তাঁরা? বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ জানাল চিকিৎসাসেবা দিতে। তারপর পাঁচ চিকিৎসক বন্ধু মিলে ৪৫ জনের চিকিৎসা করান।

আড্ডা থেকেই সব

‘আমরা আড্ডা দিই। ঢাকার উত্তরা, মিরপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুরসহ আরও অনেক জায়গায়। কিন্তু আড্ডা দিলেও সব সময় আমাদের চিন্তাজুড়ে থাকে ভালো কিছু করা। এই গ্রুপের সদস্য এখন যা আছে তা আমরা বাড়াতে চাই।’ বললেন গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হোসেন। জানালেন, ২০০০ সালে প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী এসএসসি পাস করেছে। তাঁদের অনেকে যদি এখানে যুক্ত হয়, তাহলে অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। নাজমুল যোগ করেন, আমাদের গ্রুপ তৈরির পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দুবাইতে আলাদা সমাবেশ হয়েছে। তাঁরাও আমাদের নানা কার্যক্রমে অর্থ দিয়ে সহায়তা দিচ্ছেন।

ভবিষ্যতের ভাবনা

কাজী ইশতিয়াক নেওয়াজ বললেন, ‘সব ধরনের পেশার মানুষ আছে আমাদের এই গ্রুপে। সবাই যদি সবার জায়গা থেকে এগিয়ে আসেন তাহলে তা হয় অনেক বড় শক্তি। আমরা চাই না আমাদের ব্যাচের কেউ বেকার থাকুক, বিনা চিকিৎসায় মারা যাক বা তাঁদের বিপদে একাই লড়ুক। আমরা সবাই এক হয়ে লড়তে চাই।’

এভাবেই তাঁরা তাঁদের গ্রুপের নামের যথার্থতা প্রমাণ করতে চান।