একসঙ্গে ৩১ জন

২১ মার্চ একসঙ্গে অনেক সাঁতারু পাড়ি দিয়েছেন বাংলা চ্যানেল। ছবি: সংগৃহীত
২১ মার্চ একসঙ্গে অনেক সাঁতারু পাড়ি দিয়েছেন বাংলা চ্যানেল। ছবি: সংগৃহীত
তাঁর নাম মোহাম্মদ শোয়েব। বয়স ৬৯ বছর এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী। বয়স ও শারীরিক বাধা দূরে ঠেলে পাড়ি দিলেন উত্তাল বঙ্গোপসাগরের বাংলা চ্যানেল। ২১ মার্চ শোয়েবসহ মোট ৩১ জন সাঁতারু একসঙ্গে জয় করেছেন বাংলাদেশ। এর আগে এত বেশি সাঁতারু এ পথ পাড়ি দেননি। এ দলে আরও আছে দুই কিশোরী ও এক কিশোর। একাধিক রেকর্ড তৈরি হয়েছে এবারের বাংলা চ্যানেল সাঁতারে। এ আয়োজনের কথাই থাকছে প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে।

২১ মার্চ ৯টা ৪৫ মিনিটে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে বঙ্গোপসাগরের পানিতে নামেন ৩৪ জন সাঁতারু। সাঁতারের গন্তব্য সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেবেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত ৩১ জন সফল হন কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত ১৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দূরত্বের বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদীর স্রোতোধারা বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিতে।

৬৯ বছর বয়সী মোহাম্মদ শোয়েব,১৩ বছরের সোহাগী আক্তার
৬৯ বছর বয়সী মোহাম্মদ শোয়েব,১৩ বছরের সোহাগী আক্তার

ষড়জ অ্যাডভেঞ্চার ও এক্সট্রিম বাংলার আয়োজনে ১৪তম ফরচুন বাংলা চ্যানেল সাঁতার প্রতিযোগিতা নামের এ আয়োজনে রেকর্ড হয়েছে বেশ কয়েকটি। একসঙ্গে ৩১ জন সাঁতারুর বাংলা চ্যানেল জয় এই প্রথম। ৬৯ বছর বয়সী শারীরিক প্রতিবন্ধী মোহাম্মদ শোয়েব হলেন সবচেয়ে বয়স্ক বাংলা চ্যানেল বিজয়ী। একই সঙ্গে প্রতিবন্ধী হিসেবে বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দেওয়ার রেকর্ডও তৈরি করলেন।
এবারের এ দলটিতে আরও ছিলেন এক কিশোর, দুই কিশোরী ও একই পরিবারের তিনজন।

কিছুই বাধা নয় তাঁর কাছে
তখন তাঁর বয়স ৪ বছর। আক্রান্ত হলেন পোলিও রোগে। ভালো চিকিৎসা না পেয়ে পুরো ডান পা শুকিয়ে যায়। চলাফেরায় সমস্যা হতে থাকে। ছোটবেলায় ঢাকার কেরানীগঞ্জে নানিবাড়ি বেড়াতে গিয়ে পুকুরে পড়ে যান। ওই সময় তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত কোনোরকমে রক্ষা পান। এরপর থেকে সাঁতার শেখা শুরু করেন মোহাম্মদ শোয়েব। এখন তাঁর বয়স ৬৯ বছর। তবে মনেপ্রাণে তরুণ। আদি বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জ বড় মসজিদ এলাকায়, বর্তমানে থাকেন ঢাকার গুলশানে। দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রী নাসরিন বেগমকে নিয়ে তাঁর সংসার।

একে তো বয়স, তার ওপর পোলিও আক্রান্ত পা নিয়েই তিনি এবার পাড়ি দিলেন বঙ্গোপসাগরের বাংলা চ্যানেল। স্ত্রী নাসরিন বললেন, ‘আমি সাগরকে খুবই ভয় পান বলে এখনই পর্যন্ত কক্সবাজার যাওয়া হয়নি। আর স্বামী সাগর পাড়ি দিয়ে ইতিহাস তৈরি করছেন। বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার এক মাস আগে তিনি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপরও সাঁতার নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন এবং বলতেন, তিনি একটা কিছু করবেন। তিনি পেরেছেন এবং তাঁর কথা রেখেছেন।’
‘বয়স হলেও যে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, সেটাই প্রমাণ করার জন্য আমি এ বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিলাম’—সাঁতার সম্পন্ন হওয়ার পর এভাবেই বললেন মোহাম্মদ শোয়েব। তাঁর এই সাঁতার বাংলাদেশের যুবসমাজকে উৎসাহী করে তুলবে বলে আশা করেন। ‘মানুষের অসাধ্য কোনো কিছুই নেই। আমি একজন প্রতিবন্ধী হলেও আগামী দিনে ইংলিশ চ্যানেলটি পাড়ি দিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বাংলাদেশের নাম লেখাতে চাই।’

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিতে নামছেন সাঁতারুরা। ছবি: লেখক
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিতে নামছেন সাঁতারুরা। ছবি: লেখক

বাংলা চ্যানেলের দ্রুততম সাঁতারু সাজ্জাদ
১৯ বছর বয়সী বগুড়া সরকারি কলেজের বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র সাজ্জাদ হোসেন। এবারই প্রথম বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখিয়েছেন। ২ ঘণ্টা ৫৯ মিনিট সময় নিয়ে দ্রুততম সাঁতারু হিসেবে জয় করলেন বাংলা চ্যানেল। এর আগের রেকর্ড ছিল সাইফুল ইসলামের। গত বছর ৩ ঘণ্টা ৮ মিনিট ৭ সেকেন্ডে তিনি পাড়ি দেন এই চ্যানেল। এবার ৩ ঘণ্টা ৫০ মিনিট সময় নিয়ে তিনি হয়েছেন তৃতীয়।
সাজ্জাদ জানালেন, বগুড়া পৌর পার্কে মাসুদ রানা নামের একজন প্রশিক্ষক তাঁকে সাতার শেখাতেন। বললেন ‘বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছি। আমার উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো মূল্যে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বিজয়ের স্বাদ নেওয়া। আমার আশা পূরণ হয়েছে। ভবিষ্যতে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে চাই।’
এবারের আয়োজনে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন বগুড়ার নিশিন ধারা ফকির উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র মো. নয়ন আলী। ৩ ঘণ্টা ৩৩ মিনিটে পাড়ি দিয়েছেন বাংলা চ্যানেল।

পদক পাওয়া সাঁতারুদের সঙ্গে লিপটন সরকার (মধ্যে)
পদক পাওয়া সাঁতারুদের সঙ্গে লিপটন সরকার (মধ্যে)

এক পরিবারের তিনজন
১৪ বছর ধরে প্রতিবছর সফলভাবে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া একমাত্র সাঁতারু লিপটন সরকার। এবার তাঁর পরিবারের চারজন একসঙ্গে সাঁতার শুরু করেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনজন সফলভাবে তা শেষ করতে পেরেছেন। লিপটন সরকার নিজে, তাঁর ভাতিজা মো. আল সাদ সরকার ও বড় ভাগনির ছেলে নাহিদ হাসান। মো. আল শাদ সরকারের বয়স মাত্র ১৪ বছর। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। ছোটবেলায় লালমনিরহাটের বাড়িতে লিপটন সরকারের কাছে সাঁতারে হাতেখড়ি। চার বছর আগে ঢাকায় আসার পর চাচার সঙ্গে সাঁতার অনুশীলন করে গত বছর বাংলা চ্যানেলের অর্ধেকের বেশি পথ পাড়ি দিতে পেরেছিল। এবার ৫ ঘণ্টা ৩৮ মিনিটে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিল এই কিশোর।

আছে দুই কিশোরী
গাইবান্ধা এন এইচ মডার্ন উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সোহাগী আক্তার (১৩)। গাইবান্ধা সদরের পূর্ব সবুজপাড়ার গোলাপ রব্বানী ও বেলি আক্তারের আট ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট সোহাগী এই প্রথম পাড়ি দিল বাংলা চ্যানেল। এ পর্যন্ত এই চ্যানেলজয়ী সাঁতারুদের মধ্যে তার বয়সই সবচেয়ে কম।
অপর কিশোরী ১৬ বছরের মোছাম্মৎ মিতু আখতার এবার দ্বিতীয়বারের মতো জয় করল বাংলা চ্যানেল। এর আগে বাংলাদেশ গেমসে সাঁতারে সাতটি পদক জয় করেছে।

বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া দুই কিশোরী—সোহাগী ও মিতু
বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া দুই কিশোরী—সোহাগী ও মিতু

সাঁতার যেন সেন্ট মার্টিনের উৎসব
প্রতিবছরই বাংলা চ্যানেল সাঁতারের সময় উৎসবে মেতে ওঠে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপটি। সেন্ট মার্টিনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ‘এই চ্যানেলে একসঙ্গে এত বেশি সাঁতারু এর আগে সাঁতার কাটেননি। তবে এবার নজর ছিল বয়স্ক সাঁতারু মোহাম্মদ শোয়াইব এবং তিন কিশোর–কিশোরীর দিকে। তাঁদের অভিনন্দন জানাই।’
আয়োজক ষড়জ অ্যাডভেঞ্চারের প্রধান নির্বাহী লিপটন সরকার বলেন, ‘স্পোর্টস অ্যাডভেঞ্চারকে জনপ্রিয় করার পাশাপাশি বাংলা চ্যানেলকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচয় করাতে ১৩ বছর ধরে এ আয়োজন অব্যাহত রয়েছে। বাংলা চ্যানেল সুইমিং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি বয়ে আনবে।
২০০৬ সালের ১৪ জানুয়ারি বাংলা চ্যানেলে সাঁতার আয়োজনের যাত্রা শুরু হয়। এর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন প্রয়াত কাজী হামিদুল হক। তিনি ছিলেন একজন আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার ও স্কুবা ডাইভার। তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রথমবারের মতো ফজলুল কবির সিনা, লিপটন সরকার ও সালমান সাঈদ ২০০৬ সালে ‘বাংলা চ্যানেল’ পাড়ি দেন। এরপর থেকে প্রতিবছরই এ আয়োজন করা হয়ে থাকে।
১৪তম বাংলা চ্যানেল সাঁতার আয়োজনে সহযোগিতা করেছে ইউনাইটেড সিকিউরিটিজ লিমিটেড, অফরোড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। এডিবল অয়েল লিমিটেডের ব্র্যান্ড ফরচুন ছিল এর পৃষ্ঠপোষক। এডিবল অয়েল লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক ইনাম আহমেদ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

যাঁরা বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিলেন
সাজ্জাদ হোসেন, মো. নয়ণ ইসলাম, মো. সাইফুল ইসলাম, মো. মনিরুজ্জামান, মিতু আক্তার, মোহাম্মদ শামসুজ্জামান, হেমায়েত উল্লাহ, মো. রফিকুল ইসলাম, শ্রী শংকর চন্দ্র বর্মণ, মো. মাজেদ মিয়া, আবদুল্লাহ আল রোমান, ফেরদৌস আলম, মাহাদি হাসান, মো. মুসা হারুন, শেখ মাহবুব উর রহমান, মোসাদ্দেক আহমেদ, মো. নাহিদ হাসান, জামশেদুল আলম, সোহাগী আক্তার, মিজানুর রহমান, আবু তাহের, আল্লামা দিদার, মো. আবদুল্লাহ আল মামুন, মো. আল শাদ সরকার, মোহাম্মদ শোয়েব, লিপটন সরকার, মো. আলমগীর, মুনতাসির সামি, সাইফুল বাশার, হাসিবুল হাসান ও ইয়াকুব আলী।