ভালো চিকিৎসক হওয়ার প্রথম শর্ত - ভালো মানুষ হও : লোটে শেরিং

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীদের সামনে বক্তব্য দিচ্ছেন লোটে শেরিং। ছবি: পিআইডি
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীদের সামনে বক্তব্য দিচ্ছেন লোটে শেরিং। ছবি: পিআইডি
১৪ এপ্রিল নিজের পুরোনো ক্যাম্পাস, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে গিয়েছিলেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি।

আজ এখানে থাকতে পেরে আমি খুব আনন্দিত। এ কারণে নয় যে আমি এখানকার ছাত্র ছিলাম। আমি আমার জীবনের ১০ বছর এই দেশে কাটিয়েছি, কারণ সেটাও নয়। কারণ, আমি খুব বিশেষ একটা দিনে এখানে এসেছি—আপনাদের পয়লা বৈশাখ। যেহেতু আপনারা চাচ্ছেন আমি বাংলায় কথা বলি, আমি চেষ্টা করব। বাংলাদেশ ছেড়ে গিয়েছিলাম ২০০২ সালে। বাংলা বেশির ভাগই ভুলে গেছি। যেহেতু এখানে অনেক পরিচিত মুখ দেখতে পাচ্ছি, এই মুখগুলো দেখে হয়তো কিছুটা স্মরণ করতে পারব।

আমি এই মেডিকেলে এসেছিলাম ১৯৯১ সালে। এখানে আসার আগেই বন্ধুরা পড়া শুরু করে দিয়েছিল, আমি ৪-৫ মাস দেরি করে পৌঁছেছি। অতএব মেধাবী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মেলাতে আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমি আমার নিজের মতো করে কিছু পথ তৈরি করে নিয়েছি। যেমন ধরুন, যখন আমাদের অ্যানাটমি পড়ানো হতো, শিক্ষক পড়ানোর আগেই আমি অন্তত একবার বিষয়টির ওপর চোখ বুলিয়ে নিতাম। আমি আমার জীবনে একটা জিনিস শিখেছি। আপনি যদি জীবনে কিছু শিখতে চান, তাহলে পড়ে শিখতে পারবেন না। আপনাকে আলোচনা করতে হবে। লেকচার থেকে শেখা যায়, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। অতএব আমার লেকচারে কান দেবেন না (হাসি)।

সন-তারিখ খুব ভালো মনে নেই। তখন আমি চতুর্থ বর্ষে ছিলাম। সন্ধ্যায় আমার পেটব্যথা শুরু হলো। রাত নয়টার দিকে একবার বমিও হলো। তখন আমি আমার এক বছরের সিনিয়র, মালয়েশিয়ার বন্ধু ডা. সেলভা রাজাকে ডেকে নিলাম। মধ্যরাতে তাকে ডেকে বললাম, সেলভা, আমার শরীর খারাপ লাগছে। সে আমার রুমে এল। বাকি রাতটা আমার সঙ্গেই ছিল। বেশ কয়েকবার বমি করলাম। সকালে সে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। কর্তব্যরত চিকিৎসক আমাকে ওমিপ্রাজল দিয়ে বললেন, যাও, বিশ্রাম নাও। আমি রুমে ফিরে বিশ্রাম নিলাম। সন্ধ্যা হলো, তবু ঠিক হচ্ছিল না। রেনিটিডিন খাই, ওমিপ্রাজল খাই, কিছুই কাজ করছিল না।

ঢাকায় লোটে শেরিং ও তাঁর শিক্ষক ডা. এম খাদেমুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকায় লোটে শেরিং ও তাঁর শিক্ষক ডা. এম খাদেমুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

পরদিন সকালে একই চিকিৎসকের কাছে আবার গেলাম। তিনি বললেন, বিশ্রাম নিতে চাইলে শিক্ষার্থীদের কেবিনে ভর্তি হয়ে যাও। আমি ভর্তি হলাম। ওষুধ চলছে, চিকিৎসকেরা রাউন্ডে আসছেন, তবু ঠিক হচ্ছে না। দিনের পর দিন আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। জানি না কত দিন পর, অন্য এক দল চিকিৎসক এলেন। সন্ধ্যায় একজন এলেন, যাঁকে আমি চিনতাম না। ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘আরে, এই ছেলেটাকে এভাবে রাখার কোনো মানে হলো? এটা তো অ্যাপেন্ডিসাইটিস। এটা তো বার্স্ট হচ্ছে। সে কত দিন ধরে এভাবে পড়ে আছে? আমাদের সঙ্গে আলোচনা করলেও হতো।’ আমি তাঁর কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। তখন তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘চিন্তা কোরো না। তোমার যত দ্রুত সম্ভব সার্জারি করা দরকার। আমি অপারেশন করব। আমি শত শত বার এ ধরনের অপারেশন করেছি। নিশ্চিত থাকো, তোমার কিচ্ছু হবে না।’ সে রাতেই আমার অপারেশন হলো। ২ সপ্তাহ অসুস্থ থাকার পর আমি দেশে গেলাম। কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে আবার ফিরে এলাম। আবার আমার রুটিনমাফিক দিন শুরু হলো।

তখন আমার মনে হলো, রোগীকে দেখতে হলে ভালো করে দেখতে হবে। ঝটপট একটা প্রেসক্রিপশন দিয়ে দিলে ডায়াগনোসিস ভুল হয়ে যায়। এটা আমরা সব সময় করি। কিন্তু সেই দিন আমার নিজের ওপর হয়েছে বলে আমার মনে আছে এখনো। আমরা আমাদের কাজটা একটু হালকাভাবে নিলে আরেকজনের জীবন বিপন্ন হতে পারে। দয়া করে কাজটাকে খুব সিরিয়াসলি নিন। আমরা দিন-রাত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোগী দেখি, সে জন্য কাজটা রুটিন হয়ে যায়। আমরা মেনে নিই, এটা তো আমাদের কাজ। সব সময় রোগীদের সঙ্গে আলাপ করতে থাকি, সে জন্য কিছু বিষয় দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। আমরা রোগীদের সঙ্গে সব সময় থাকি, কিন্তু রোগীরা আমাদের সঙ্গে সব সময় থাকে না। তারা আমাদের কাছে একবারই আসে। সে জন্য প্রত্যেক রোগীকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।

আমার মনে আছে, সেই ডাক্তার যখন বললেন, ‘এটা তো অ্যাপেন্ডিসাইটিস’; যদিও আমি চতুর্থ বর্ষের মেডিকেলের ছাত্র, যদিও আমি জানি অ্যাপেন্ডিসাইটিস কী, আমি জানি এই অপারেশন রেসিডেন্টরাও (আবাসিক শিক্ষক) করতে পারে, কিন্তু নিজে রোগী হলে একটা টেনশন তো আসে। যখন সেই অধ্যাপক বললেন, ‘দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তোমার মা-বাবা দূরে থাকে। কিন্তু তোমাকে দেখার জন্য আমরা তো এখানে আছি।’ এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যথাই হারিয়ে গেছে। যিনি আমার অপারেশন করেছিলেন, তিনি অধ্যাপক খাদেমুল ইসলাম। যেহেতু তিনি আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন, আমি তাঁকে বিশ্বাস করেছি। এরপর থেকে অধ্যাপক খাদেমুল ইসলাম আর লোটের সম্পর্ক বদলে গিয়েছিল। সেই ঘটনা থেকে আমি বুঝেছি, মানুষের জীবনে মেডিকেল পেশার ভূমিকা কত বড়! কারণ, আমরা শুধু মানুষ নিয়ে কাজ করি, তা না। আমরা একজন মানুষকে নিয়ে কাজ করি তখন, যখন সে খুব সংকটপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

অধ্যাপক খাদেমুল ইসলামের সংস্পর্শে আসার পর আমি সার্জন হওয়ার উৎসাহ পেলাম। তাঁকে অনুসরণ করে আমি সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে গেছি, সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছি, বিসিপিএস থেকে এফসিপিএস করেছি। যেদিন এফসিপিএস পার্ট টু পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো, মনে আছে আমরা সবাই নিচে অপেক্ষা করছিলাম। অধ্যাপকের একটা দল নিচে নেমে এলেন। আমি দেখলাম অধ্যাপক খাদেমুল কাউকে খুঁজছেন। তিনি আমাকেই খুঁজছেন ভেবে আমি মাথাটা একটু উঁচু করলাম। তিনি আমাকে কাছে ডাকলেন। বললেন, ‘মাই বয়, ইউ হ্যাভ ডান ইট।’ আনুষ্ঠানিকভাবে ফল প্রকাশের আগেই স্যার আমাকে জানিয়েছিলেন, আমি পাস করেছি। আমি এসব কথা বলছি শুধু একটা কথা বোঝাতে। আমাদের জীবনে শিক্ষকদের ভূমিকা অনেক বড়। ছাত্রজীবনে আমরা সেটা বুঝি না। যখন বুঝি, তত দিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। অতএব শিক্ষার্থীরা, শিক্ষকেরা সব সময় তোমাদের পাশে আছেন। এই সুযোগটা কাজে লাগাও।

আমি সব সময় একটা কথা বলি। প্রিয় শিক্ষার্থীরা, তোমাদেরও সে কথাটা বলতে চাই। আমার সঙ্গে যারা প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে কাজ করে, আমি তোমাদের বলি, আমার কোনো সন্দেহ নেই যে তোমরা একদিন সার্জন হবে। তোমরা কতটা ভালো সার্জন হবে, সেটাই প্রশ্ন। ভালো সার্জন কোথা থেকে আসবে? পাঠ্যবই থেকে নয়। ভালো সার্জন হতে হলে যা প্রয়োজন, তার মধ্যে এক নম্বর হলো—ভালো মানুষ হতে হবে। আমি আশা করব এখানে যারা আছে, তারা সবাই ভালো মানুষ।

মানুষ বলে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী হও। আমি বলি, না। উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়ার দরকার নেই। ভালো মানুষ হও। তোমার কাছে যেটা ঠিক মনে হয়, তা-ই করো। নিজের সেরাটা দাও। ধন্যবাদ।
(সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)