গ্রামটিতে থামছেই না বাল্যবিবাহ

এক কিশোরী মায়ের কোলে শিশু।  প্রথম আলো
এক কিশোরী মায়ের কোলে শিশু। প্রথম আলো

চতুর্থ শ্রেণিপড়ুয়া আলেয়া সুন্দর সুন্দর পুতুল পাওয়ার লোভে বিয়েতে রাজি হয়। তাকে বলা হয়েছিল, শ্বশুরবাড়িতে গেলেই পুতুল পাবে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি গিয়ে জানতে পারে, এটি খেলার জায়গা না। মেয়েটি পালিয়ে চলে আসে। স্বামীর মামলা করার হুমকিতেও কাজ হয়নি। প্রায় ছয় মাস সে বাবার বাড়িতেই রয়েছে।

সম্প্রতি রাজশাহীর চরখিদিরপুর গ্রামে এই মেয়েটির মতো অন্য শিশুদেরও বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। সংসার না বোঝা, যৌতুকের চাপসহ নানান কারণে তাদের বিয়ে ভেঙে যায়। তবে রেহাই নেই, তাদের একাধিকবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। গত ছয় থেকে সাত মাসে গ্রামটিতে এ রকম ১৬টি বাল্যবিবাহ হয়েছে।

রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের চরখিদিরপুর, চরতারানগর ও খানপুরের মধ্যে পদ্মা নদীর ভাঙনে চরতারানগর ও খানপুর শুধু নামেই আছে। বাস্তবে এই তিন গ্রামের লোক এখন খিদিরপুরেই বাস করেন। এই গ্রামের লোকেরা বাল্যবিবাহের ব্যাপারে আইন-আদালতকে মোটেই আমলে নেন না।

পদ্মা নদীর মাধ্যমে রাজশাহীর মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে খিদিরপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসনের হস্তক্ষেপও কম।

গত ২৯ এপ্রিল ওই গ্রামে গিয়ে বিবাহিত শিশু ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়। একটি বাড়ির বারান্দায় সন্তান কোলে বসে ছিল শিশু সানোয়ারা। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় সানোয়ারার বিয়ে হয়েছিল। ৩০ বছর বয়সী স্বামীর বাড়িতে ছিল মাত্র সাত মাস। যৌতুকের জন্য সানোয়ারাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিলে সানোয়ারার বাবা ১৫ হাজার টাকার জিনিসপত্র দিয়ে তাকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠান। তবে সাত দিন পর আবার বাবার বাড়ি থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে যেতে বলেন। তা দিতে না পারায় সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা সানোয়ারার ঠাঁই হয়েছে বাবার বাড়িতে। তার ছেলের বয়স এখন দেড় বছর।

সানোয়ারা বলল, সংসার টিকিয়ে রাখতে এ পর্যন্ত তিন-চারবার সালিস ডাকা হলেও তার স্বামী একবারও উপস্থিত হননি।

সানোয়ারার প্রতিবেশী বাল্যবিবাহের শিকার রাশিদা বেগম (৩৫) বললেন, এই গ্রামে বউ পিটিয়ে মেরে ফেললেও কেউ কিছু বলবে না।

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় গ্রামের একটি মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। পরে তার বিয়ে ভেঙে যায়। মেয়েটি আবার বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা-মা তাকে আবার বিয়ে দেন। ২০১৪ সালের ১০ আগস্ট পবা উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা রাজ্জাকুল ইসলাম এই মেয়ের বাবাকে পুলিশ দিয়ে আটক করিয়েছিলেন। ওই সময় গ্রামের লোকেরা এসে ওয়াদা করেন এই গ্রামে আর কেউ বাল্যবিবাহ দেবেন না। তারপর বাবাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে মেয়েটির ওই বিয়ে টেকেনি। বছরখানেক হলো মেয়েটিকে আবারও বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই মেয়েটির ছোট বোনের এবার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেয়েটির পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে তাকেও বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্র খুঁজছে পরিবার।

গত বছর ৭ সেপ্টেম্বর ১৩ বছর বয়সী একটি মেয়ের বিয়ের আয়োজনের খবর পেয়ে পবা উপজেলার সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসি ল্যান্ড) নুরুল হাই মো. আনাছ বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে ছেলে ও মেয়ের অভিভাবকদের মুচলেকা নেন। পবা উপজেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসের পক্ষ থেকে মেয়ের পড়ালেখার দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার দুদিন পর গোপনে মেয়েটির বিয়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি জানার পরে পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বাদী হয়ে মেয়ের বাবাসহ বিয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আসামি করে কাঁটাখালী থানায় একটি মামলা করেন। এ ঘটনার পরও ওই গ্রামে ১৬টি বিয়ে হয়েছে।

চরতারানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানালেন, গত দুই বছরে বিদ্যালয়টিতে বিভিন্ন শ্রেণিতে পড়ুয়া পাঁচ শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি লালচানের মতে, এলাকার বেশির ভাগ মানুষ অশিক্ষিত। একটু বড় হলেই ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হয়ে যাবে, এই ভয়ে অভিভাবকেরা মেয়েকে কম বয়সেই বিয়ে দিতে চান।

হরিয়ান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বললেন, জন্মনিবন্ধন কার্ড ছাড়া বিয়ে নিবন্ধন করা যায় না বলে গ্রামের লোকেরা মসজিদের ইমামকে ডেকে বিয়ে পড়িয়ে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেন।