নিজের নাম ভুলে গিয়েছিলাম: এমিলিয়া ক্লার্ক

ডেনেরিস টারগেরিয়ানের রূপে এমিলিয়া
ডেনেরিস টারগেরিয়ানের রূপে এমিলিয়া
যুক্তরাজ্যের অভিনেত্রী এমিলিয়া ক্লার্ক। নিজের নাম ছাপিয়ে বিখ্যাত টিভি সিরিজ ‘গেম অব থ্রোনস’–এর ‘ডেনেরিস টারগেরিয়ান’ চরিত্রে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন। টাইম সাময়িকী তাঁকে ২০১৯ সালের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ মানুষের একজন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দুইবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেও কীভাবে তিনি সফল হলেন? দ্য নিউ ইয়র্কার সাময়িকীতে সে কথা লিখেছেন স্বয়ং এমিলিয়া। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ২১ মে।

যখন আমার ছেলেবেলার সব স্বপ্ন সত্যি হতে শুরু করল, তখনই আমি জীবনটা হারাতে বসেছিলাম। কখনো জনসমক্ষে এসব কথা বলিনি, কিন্তু আমার মনে হয়, এখন বলার সময় হয়েছে।

২০১১ সালের শুরুর দিকের কথা। তখন মাত্রই ‘গেম অব থ্রোনস’–এর প্রথম সিজনের কাজ শেষ করেছি। প্রায় কোনো রকম পেশাগত পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই আমাকে ডেনেরিস টারগেরিয়ানের চরিত্র দেওয়া হয়েছিল। ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, নর্থ লন্ডনে, ক্রাউচ এন্ডের একটা জিমের লকার রুমে আমি ব্যায়ামের পোশাক পরে তৈরি হচ্ছিলাম। হঠাৎই বুঝতে পারলাম, একটা বাজে ধরনের মাথাব্যথা শুরু হতে যাচ্ছে। এতই অবসন্ন লাগছিল যে জুতাটাও পরতে পারছিলাম না। শরীরের ওপর একরকম জোর করেই ব্যায়াম শুরু করলাম। আমি ব্যথাটা অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পারছিলাম না। একসময় আমার ট্রেনারকে বললাম, আমার একটু বিরতি দরকার। কোনো রকম হামাগুড়ি দিয়ে লকার রুমে পৌঁছলাম। ভয়াবহ অসুস্থ লাগছিল। একপর্যায়ে বুঝতে পারলাম, আমার মাথা কাজ করছে না।

কিছুক্ষণের জন্য সব ব্যথা আর ঝিমুনি ভাবটাকে ঠেলে সরাতে চেষ্টা করলাম। মনে মনে বললাম, ‘আমি প্যারালাইজড হব না।’ কথাটা বিশ্বাস করতে আঙুল আর পায়ের পাতা নাড়াতে চেষ্টা করলাম। মস্তিষ্কটাকে সচল রাখতে নানা কিছু স্মরণ করার চেষ্টা করলাম, এমনকি ‘গেম অব থ্রোনস’–এর সংলাপও।

এমিলিয়া ক্লার্ক
এমিলিয়া ক্লার্ক

আবছাভাবে একজন নারীর কণ্ঠ শুনতে পেলাম। তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন, আমি ঠিক আছি কি না। এরপর হঠাৎই সব ঝাপসা হয়ে গেল। মনে আছে আমি অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনতে পাচ্ছিলাম। চারদিকে অনেক মানুষের কোলাহল। কে যেন বলল, আমার পালস দুর্বল। কেউ একজন আমার ফোন থেকে মাকে ফোন করে বলল, সে যেন দ্রুত হুইটিংটন হাসপাতালে চলে আসে।

যাহোক, এমআরআই ও ব্রেন স্ক্যান করে জানা গেল, মস্তিষ্কের চারপাশে রক্তক্ষরণের কারণে আমার স্ট্রোক করেছিল। এটা এতই ভয়াবহ যে মৃত্যুও হতে পারত। মনে আছে, অস্ত্রোপচারের আগে আমাকে একটা ফরমে সই করতে বলা হয়েছিল। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার? আমি তখন খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি—অস্ত্রোপচার করার আমার সময় কোথায়! কিন্তু শেষ পর্যন্ত থিতু হলাম, সই করলাম। ৩ ঘণ্টার দীর্ঘ অচেতন সময়টাতে চিকিৎসক আমার মস্তিষ্ক মেরামত করছিলেন। আমার বয়স তখন মাত্র ২৪। অক্সফোর্ডে বড় হয়েছি, স্বাস্থ্য নিয়ে কখনোই খুব একটা ভাবিনি। আমার ধ্যানজ্ঞান জুড়ে ছিল অভিনয়।

জ্ঞান ফেরার পর অসহনীয় ব্যথা হচ্ছিল। কোথায় আছি বুঝতে পারছিলাম না। তবে টের পাচ্ছিলাম, গলার ভেতর দিয়ে একটা টিউব চলে গেছে। চার দিন পর আমাকে আইসিইউ থেকে বের করা হলো। চিকিৎসক বলেছিলেন, কষ্ট সহ্য করে আমি যদি ২ সপ্তাহ পার করে দিতে পারি, তাহলে বোঝা যাবে আমি ভালোভাবে সেরে উঠছি।

সেই দুঃসহ সময়টাতে এক দিন এক নার্স আমার ঘুম ভাঙালেন। নিয়মিত চিকিৎসার অংশ হিসেবেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কী?’ আমার পুরো নাম এমিলিয়া ইসোবেল ইউফেমিয়া রোজ ক্লার্ক। কিন্তু আমি আমার নাম মনে করতে পারছিলাম না। নামের বদলে আমার মুখ দিয়ে এলোমেলো শব্দ বেরোতে লাগল, একটা ভয়ংকর আতঙ্ক ভর করল। এ রকম ভয় আমার কখনো লাগেনি—যেন নরক এগিয়ে আসছে। যেই আমাকে সংলাপ মনে রাখতে হয়, সেই আমি নিজের নাম মনে করতে পারছিলাম না।

আমি যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, এটাকে বলা হয় অ্যাফেজিয়া। আমি ক্রমাগত অসংলগ্ন কথা বলতাম, কিন্তু মা এমন একটা ভাব করত, যেন সব ঠিক আছে। যখন খারাপ লাগাটা আর সহ্য করতে পারতাম না, তখন টেনে প্লাগ খুলে ফেলতে চাইতাম। মেডিকেল স্টাফদের বলতাম, আমাকে মরতে দাও। আমার কাজ, আমার স্বপ্ন, সবকিছু নির্ভর করছে ভাষা আর কথা বলার ওপর। এটা ছাড়া তো আমি কিছুই না।

আমাকে আবার আইসিইউতে পাঠানো হলো। এক সপ্তাহ পর অ্যাফেজিয়া কেটে গেল। তখন কথা বলতে পারছিলাম। নাম মনে করতে পারছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম, আইসিইউতে আমার আশপাশে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবে না। প্রতিনিয়ত নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম, আমি কতটা সৌভাগ্যবান। একটা গোসল আর নির্মল বাতাসের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে ১ মাস পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলাম। কয়েক সপ্তাহ পরেই আমার ‘গেম অব থ্রোনস’–এর সেটে ফেরার কথা।

২০১৩ সালে নিয়মিত পরীক্ষা–নিরীক্ষার অংশ হিসেবে আবার আমাকে মস্তিষ্ক স্ক্যান করতে হলো। সবকিছু দেখে চিকিৎসক জানালেন, আমার মস্তিষ্কের একটা অংশ আকারে দ্বিগুণ হয়ে গেছে, এটার একটু ‘দেখভাল’ করতে হবে। আমাকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, এবারের অস্ত্রোপচারটা আগের বারের চেয়ে সহজ হবে। কিছুদিনের মধ্যেই আমি আবার রোগীর পোশাকে নিজেকে আবিষ্কার করলাম ম্যানহাটন হাসপাতালের একটা রুমে। মা-বাবা সেখানে ছিল। ‘দুই ঘণ্টা পর তোমার সঙ্গে দেখা হবে’, বলে তারা বেরিয়ে গেল। জ্ঞান ফেরার পর আমি ব্যথায় চিৎকার করছিলাম। চিকিৎসক পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, দ্রুতই আবার অস্ত্রোপচার না করা হলে আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল খুবই ক্ষীণ।

সেরে ওঠার প্রক্রিয়াটা এবার প্রথমবারের চেয়েও কঠিন ছিল। আমাকে দেখলে মনে হতো আমি এমন একটা যুদ্ধ অতিবাহিত করে এসেছি, যেমনটা ডেনেরিসের অভিজ্ঞতাতেও নেই। মাথা থেকে বেরিয়ে আসা একটা নলসমেত অস্ত্রোপচারের টেবিল থেকে উঠেছি। খুলির একটা অংশ ছিল টাইটেনিয়াম দিয়ে ঢাকা। করোটি থেকে শুরু করে কান পর্যন্ত যে লম্বা ক্ষতচিহ্ন, সেটি আপনারা এখন আর দেখতে পান না। কিন্তু তখনো আমি জানতাম না যে এটা দেখা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা, যেকোনো সময় শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার একটা ভয় আমাকে ঘিরে থাকত। আমি কি জ্ঞান হারাব? স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যাব? চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাবে না তো? এখন মজা করে বলি, অস্ত্রোপচারের পর থেকে কোনো পুরুষকেই আর আগের মতো ভালো লাগে না। কিন্তু তখন ব্যাপারটা একেবারেই মজার ছিল না।

আবার হাসপাতালে কাটল আমার জীবনের একটি মাস। সব আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। কারও চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না। ভয়াবহ দুশ্চিন্তা হতো, প্যানিক অ্যাটাক হতো। ছোটবেলা থেকে সব সময় শিখে এসেছি, আমার চেয়েও খারাপ অবস্থায় অনেকে আছে। কিন্তু একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বার যাওয়ার পর সব আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। মনে হতো আমি কেবল আমার একটা খোলস। এতটাই খারাপ অবস্থা গেছে যে এখন আর সেই সময়ের কথা মনে করতে পারি না।

কিন্তু এত বছর চুপ থাকার পর এখন আমি বলতে পারি, বিশ্বাস করুন: আমি জানি আমি ব্যতিক্রম নই, একা নই। অসংখ্য মানুষ আমার চেয়েও খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। আমি অসম্ভব সৌভাগ্যবান, যেই সেবা আমি পেয়েছি, তারা এর কিছুই পায়নি।

‘গেম অব থ্রোনস’ শেষ হয়েছে, এর চেয়েও বড় আনন্দের বিষয় হলো আমি শেষটা দেখতে পেরেছি আর নতুন কোনো শুরু দেখার অপেক্ষায় আছি।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ