হতাশদের স্বপ্ন দেখান শারমিন

নতুন উদ্যমে বাঁচার স্বপ্ন দেখা কয়েকজনের সঙ্গে শারমিন।  ছবি: সংগৃহীত
নতুন উদ্যমে বাঁচার স্বপ্ন দেখা কয়েকজনের সঙ্গে শারমিন। ছবি: সংগৃহীত

হতাশায় ডুবে আছেন—এমন মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার মানে খুঁজে দিতে ছুটছেন শারমিন ফারহানা চৌধুরী। আর এ কাজে তিনি মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন খেলাধুলাকে। খেলার মাধ্যমেই আনন্দ পাওয়ার পাশাপাশি হতাশ মানুষের স্বাবলম্বী করে স্বপ্ন দেখাতে শেখান তিনি।

 হুইলচেয়ার বসেও টেবিল টেনিস, বাস্কেট বল, ভলিবল খেলা যায়, তা প্রমাণ করেছেন শারমিন। বহুত ঝক্কি সামলে গ্রামের স্কুলগুলোয় মেয়েদের রাগবি খেলার দল করেছেন। তরুণদের রাগবি দলটি গত ২৯ মার্চ জাতীয় রাগবি লিগে অংশ নিয়ে দ্বিতীয় রানার্সআপ হয়েছে।

শারমিন জানালেন, বাগেরহাটে দিনের পর দিন আবদুল করিম নামের এক প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রাগবি দলটিকে। দলের খেলোয়াড়দের কেউ গ্রামে গরুর দুধ বিক্রি করেন, কেউবা ঝুপড়ি ঘরে দোকান চালান।

২০১৬ সালে শারমিন ফারহানা চৌধুরী গড়ে তোলেন স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স বাংলাদেশ, সংক্ষেপে শি নামের একটি সংগঠন। নিজের সম্পদের একটি অংশ থেকেই সংগঠনটি তিনি পরিচালনা করছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন শির ক্রীড়া উন্নয়নপ্রধান পাপ্পু লাল মোদকসহ স্বেচ্ছাসেবী কয়েকজন তরুণ, যাঁদের নিয়ে দেশের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়ান মানুষকে খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করার কাজে।

পাপ্পু লাল মোদক জানালেন, এখন পর্যন্ত ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, কক্সবাজার (রোহিঙ্গা শিবির), গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, শ্রীমঙ্গল, গাইবান্ধায় ১ হাজার ৭৬৩ জনকে তাঁদের প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন খেলায় প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

শির প্রশিক্ষণ পাওয়া কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার হিলোচিয়া ইউনিয়নের জসিম (২৭) জানান, সাত বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে এখন সাঁতার কাটতে পারেন। সাঁতার কাটায় তাঁর সঙ্গী এখন একই উপজেলার রফিকুল ইসলাম ও হুমায়ুন। এ দুজনই দুর্ঘটনায় হাঁটার শক্তি হারিয়েছেন। ১০ বছর ধরে যে রফিকুল সোজা হয়েও দাঁড়াতে পারতেন না, তিনিও সাঁতার কাটেন অন্য সব স্বাভাবিক ছেলেমেয়ের সঙ্গী হয়ে।

শারমিন ফারহানা চৌধুরী। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
শারমিন ফারহানা চৌধুরী। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

শারমিন জানান, প্রতিবন্ধী ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশাপাশি তিনি সব শ্রেণির শিশু-কিশোর-তরুণকে খেলাধুলায় সম্পৃক্ত করতে চান। তাঁর ভাষায়, মুঠোফোনে ‘গেম’ খেলা না, মাঠে এসে সরাসরি খেলতে হবে। এরই অংশ হিসেবে ফুটপাত বা পার্কে রাত কাটানো বা বস্তির শিশুদের জন্য, জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ১৫টি পার্কে শারমিন নিয়মিত আয়োজন করছেন গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতা। ২০২০ সালে জাপানের টোকিওতে প্যারালিম্পিক গেমসে যাতে অংশ নিতে পারে, এর জন্য আবুল হোসেন নামের একজন কোচের তত্ত্বাবধানে সাঁতার প্রশিক্ষণ চলছে প্রতিবন্ধী সাঁতারুদের। এ ছাড়া শির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাগেরহাটের ফকিরহাটের আরেক প্রতিবন্ধী যুবক মেহেদী হাসান হুইলচেয়ারে বসে অন্যদের ভাষায় ‘স্বাভাবিক’ ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চলছেন। মেহেদীর ঝুলিতে রয়েছে আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

চৌধুরী শাহাবুদ্দিন আহমেদ ও মাকসুদা চৌধুরীর দুই মেয়ের মধ্যে শারমিন ছোট। বাবার মৃত্যুর পর বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি) প্রতিষ্ঠায় জমি দান করা হয়।

শারমিন জানালেন, তাঁর কাজের পেছনে মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন তাঁর বাবা শাহাবুদ্দিন আহমেদ এবং সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভেলরি এন টেইলর। সিআরপিতে শারমিন দীর্ঘদিন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন।

বিত্তবৈভবের মধ্যে বড় হওয়া শারমিন এই কাজের মধ্যে দিয়ে নিজের জীবনেরও মানে খুঁজে পেয়েছেন বলে জানালেন।