বাঘ ওঁদের বিধবা করেছে

গুলজান বিবি, নাসিমা বেগম, হাসিনা খাতুন, রিনা গাইন, রোকেয়া বেগম
গুলজান বিবি, নাসিমা বেগম, হাসিনা খাতুন, রিনা গাইন, রোকেয়া বেগম

শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে ছিল গোলজান বিবি আর সোবহান গাজীর সংসার। সোবহান প্রতিদিন নদী পার হয়ে সুন্দরবন যেতেন ‘জঙ্গল করতে’। ‘জঙ্গল করা’ মানে সুন্দরবনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা।

গোলজানের ঘরের বারান্দায় বসে সুন্দরবন দেখা যায়। গোলজান-সোবহানের সংসার চলত মাছ বিক্রি করে। সোবহান কয়রার আড়তে মাছ বিক্রি করে দুপুরের আগে বাড়ি আসতেন। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার ভালোই চলছিল। গোলজান বিবি বললেন, ‘স্বামী মদ্যি মদ্যি বলত, বাঘ দেখলি ভয় করে না, বাঘ আমারে খাবে না।’

পাঁচ বছর আগের এক দিন। স্বামী বাড়ি ফেরেননি। মুহূর্তে সারা গ্রাম খবর রটে গেল, সোবহান গাজী কাল জঙ্গল করতে গিয়ে আজও ফেরেননি। গ্রামর মানুষ বনে ছুটলেন। দেখলেন, বাঘের পায়ের চিহ্ন, আর ছোপ ছোপ রক্ত। রক্তের দাগ ধরে দল বেঁধে বনে ঢুকলেন। বিকেল নাগাদ তাঁরা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের একটি মাথা পেলেন। পরদিন গ্রামবাসী দল বেঁধে আবার বনে গেলেন। শরীরের বাকি কিছু অংশ পেলেন। যা পাওয়া গেল, তা-ই বাড়ির একপাশে কবর দিলেন। বিধবা হলেন গোলজান বিবি।

বন্ধুর হাত
বাঘের কারণে বিধবা হয়েছেন কয়রা সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রোকেয়া বেগম। ১৩ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় আর তিনি বিধবা হন ২৬ বছর বয়সে।

৬ নম্বর কয়রা গ্রামের রীনা গাইনও হারিয়েছেন তাঁর স্বামী আশুতোষ গাইনকে। উত্তর বেদকাশি গ্রামের নাসিমা বেগম ও ৫ নম্বর কয়রা গ্রামের মোসাম্মত হাসিনা খাতুনসহ এই ধরনের নারীরা ‘বাঘবিধবা’ হিসেবে এলাকায় পরিচিতি।

এলাকার তরুণেরা ২০১৭ সালে ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট (আইসিডি) নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। আইসিডির জরিপ বলছে, কয়রা উপজেলায় এ রকম বিধবা আছেন সাড়ে সাত শর মতো।

গোলজান বিবি বিধবা ভাতা পান না, বয়স্ক ভাতাও পান না। মোছাম্মত হাসিনা খাতুনও কোনো ভাতা পান না। কেউ কেউ ৫০০ টাকা ভাতা পান। অনেক বাঘবিধবার দিনমজুরি করে দিন কাটে। অসুস্থ হওয়ার কারণে নাসিমা বেগম এখন তাও করতে পারেন না।

স্বামী হারানোর পর হঠাৎই বিপদে পড়েন ‘বাঘ বিধবারা’। এদের একজন হাসিনা খাতুন বলেন, ‘খাতি পাতাম না। মানসির বাড়ির পান্তাভাতের পানি চুকুক দিয়ে দিন কাটাইছি।’

এই বিশেষ ধরনের বিধবাদের সাহায্য করার চেষ্টা করছে আইসিডি। প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান বলেন, ৪০ জন বাঘবিধবাকে তাঁরা পোশাক তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং প্রত্যেককে সেলাইযন্ত্র দিয়েছেন। অনেকেই প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়েছেন।