মা কোনো কাজ করেন না

ইংলিশ মাধ্যম স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আইমান খৈয়াম জানাল, তার বাবা ব্যাংকার। আর মা? প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘মা কোনো কাজ করেন না, মা বাসায় থাকেন।’ বাসায় কিছু করেন কি না, পাল্টা প্রশ্নের উত্তরে সে বলে, রান্নাবান্নাসহ বাসার সবকিছু মা-ই করেন। রাজধানীর চিত্র এটি। মায়ের মজুরিবিহীন কাজগুলোর স্বীকৃতিতে এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে।

আর যে নারী বাইরে চাকরি করেন, আবার ঘরও সামলান, সে ক্ষেত্রেও পরিবার ঘরের কাজের স্বীকৃতিটুকু দিতে কুণ্ঠাবোধ করছে। ফলে বেশির ভাগ শিশু ছোটবেলা থেকেই ‘মা কোনো কাজ করেন না’—এ ধরনের মনোভাব নিয়ে বড় হচ্ছে। এই শিশু বড় হয়ে নিজের সংসারেও মনে করেন, স্ত্রী তো কোনো কাজ করেন না।

গত বছর বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ম্যান অ্যান্ড ম্যাসকুলিনিটিস স্টাডিজ (সিএমএমএস) পরিচালিত ‘ব্রেভম্যান ক্যাম্পেইন’–এর প্রতিবেদন বলছে, মায়ের কাজ সম্পর্কে ১২ শতাংশ ছেলে জানিয়েছিল, তাদের মা কাজ করেন। তবে ক্যাম্পেইন শেষে এই শিশুদেরই সচেতন করার পর ৯৬ শতাংশ একবাক্যে বলতে পারে, তাদের মা কাজ করেন।

সিএমএমএস ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ‘ব্রেভম্যান’ ক্যাম্পেইনের একটি কার্যক্রমে ছেলে শিক্ষার্থীদের ডায়েরি দেওয়া হচ্ছে। ডায়েরির একটি অংশে লেখা, আমার মা। ছেলে শিশুরা সেখানে মা, মায়ের কাজসহ বিভিন্ন বিষয়ে লিখে। একসময় তারা বুঝতে পারে, সংসারে মায়ের ভূমিকা কতটুকু। ডায়েরিতে মায়ের বক্তব্যও থাকে।

২০১৩ সালে ডায়েরিতে জামালপুরের এক শিক্ষার্থী লিখেছে, ঘরের কাজ করার পর মা বিশ্রাম নেওয়ার সময় খুব কম পান। তাই এ কাজে সন্তানদের সাহায্য করা প্রয়োজন। আর মা লিখেছেন, ছেলে মায়ের কষ্ট বুঝতে পারায় তিনি খুব খুশি হয়েছেন।

চলতি বছর দেশের ৫০টি স্কুলে ‘ব্রেভম্যান’ ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে। ক্যাম্পেইনে অংশ নেওয়া গাইবান্ধা জেলার পিয়ারাপুর আই জি এম স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী জয়নাল আবেদিন বলল, ‘ মা রাতদিন সব সময়ই কাজ করেন।’ এখন জয়নাল তার মায়ের কাজে সহায়তা করে । প্রতিষ্ঠানটির বাংলা বিভাগের শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন জানালেন, ব্রেভম্যান ক্যাম্পেইনটি মাত্র তিন মাস ধরে শুরু হয়েছে। তবে এ সময়েই যে অগ্রগতি, ভবিষ্যতে তা অনেক কাজে দেবে।

সিএমএমএসের চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ বললেন, পরিবারের সদস্যদের নারীর কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। এ ক্যাম্পেইনের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, মা কাজ করেন, সন্তানদের এটা বোঝানো। আর এ উপলব্ধি যখন হবে, তখনই ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে। এ বিষয়টিকে অভ্যাসে পরিণত করলে নারীদের প্রতি সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আসবে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বললেন, নারীর কাজের স্বীকৃতি দিতে রাষ্ট্রের নীতি, শিক্ষাসহ সমাজের সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে হবে। শিশুরা যখন দেখবে, বাবা বা পরিবারের অন্যরা তার মায়ের কাজকে সম্মান করছে, তখন সে–ও সম্মান করবে। একটি শিশুর মানসিকতা গঠনে পারিবারিক শিক্ষাটা জরুরি। শিক্ষা পাঠক্রমেও নারীর কাজের স্বীকৃতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধূরী বললেন, নারীর মজুরিবিহীন শ্রমের স্বীকৃতির পথে বড় বাধা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। তবে শিশুদের সচেতনতামূলক কার্যক্রমে নারী মানেই ঘরের কাজ করবে, এ ধারণা যাতে বাচ্চাদের মাথায় ঢুকে না যায়, তা মনে রাখতে হবে।