সমাধানের অংশ না হলে তুমি সমস্যার অংশ : মাইকেল ব্লুমবার্গ

মাইকেল ব্লুমবার্গ
মাইকেল ব্লুমবার্গ
>গত ৭ জুন, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) সমাবর্তনে বক্তব্য দিয়েছেন মাইকেল ব্লুমবার্গ। তিনি ব্লুমবার্গ এলপির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষের তালিকায় তাঁর অবস্থান নবম। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের মেয়র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন এই সফল ব্যবসায়ী। তাঁর সমাবর্তন বক্তৃতার পুরোটাজুড়েই উঠে এসেছে পরিবেশরক্ষার আহ্বান।

তোমরা সত্যি ভাগ্যবান, এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছ। বিশ্বের বাঘা বাঘা পণ্ডিত নিয়ে এদের কারবার! 

অসাধারণ এক প্রতিষ্ঠানের অংশ তোমরা, যা বহুবার প্রমাণ করেছে মানুষের জ্ঞানার্জনের পরিধি অসীম, অসাধ্যকে সাধন করার ক্ষমতা সীমাহীন। এটাই সেই প্রতিষ্ঠান, যা ষাটের দশকেই প্রমাণ করেছিল চাঁদে যাওয়া সম্ভব! 

পঞ্চাশ বছর আগের কথা। চাঁদের মাটি স্পর্শ করল অ্যাপোলো–১১। এমআইটির সাহায্য ছাড়া এটি প্রায় অসম্ভব ছিল। শুধু কি বাজ অলড্রিন? ব্যাচ ’৬৩–এর সেই ছেলেটা? এর পেছনে ছিল আরও কত লোকের অবদান! 

মহাকাশে সঠিক দিকনির্দেশনা দেবে এমন আধুনিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে গোটা নিয়ন্ত্রণকক্ষের নকশাটিই তৈরি করেছিল তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, এমআইটির ড্রেপার ল্যাবরেটরি। 

১৯৬০ সাল। সে সময় চাঁদে যাওয়ার বিষয়টা তেমন জনপ্রিয় ছিল না। এমনকি শুরুতে কংগ্রেসও এর পেছনে অর্থ ব্যয় করতে আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কেনেডি ছিলেন তুমুল উৎসাহী। জনগণকে বোঝালেন, ‘আজ আমরা চাঁদে যাওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছি। এ জন্য নয় যে, কাজটা সহজ। বরং কষ্টসাধ্য বলেই আমরা তা অতিক্রম করতে চাই।’ ১৯৬২ সালে তাঁর দেওয়া এই ভাষণটি যুক্তরাষ্ট্রে সাড়া জাগিয়েছিল। নাড়া দিয়েছিল অনেকের মনে। 

আমাদের আজকের দুনিয়া অনেক এগিয়ে। কারণ এই নয় যে আমরা চাঁদে পা ফেলেছি। কারণ, আমরাই প্রথম সে চেষ্টা করেছি। সাহস দেখিয়েছি। এর পেছনে অবদান যেমন প্রেসিডেন্ট কেনেডির, তেমনি বহু এমআইটি স্নাতকের। 

আবার নতুন করে এগিয়ে আসার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এবার আর শূন্যে পাড়ি নয়, বাঁচাতে হবে নিজ গ্রহকে; জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে। ১৯৬২ সালে চন্দ্র অভিযানের সময় সবচেয়ে বড় বাধা ছিল অনুন্নত প্রযুক্তি। আজকের দিনে সেই বাধা আসছে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে। 

আজ আমরা জানি, কী করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। কী করে সূর্যের আলো ও বায়ুকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা যায় বিদ্যুৎ। নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে চার্জ দেওয়া যায় ব্যাটারি, আর তা দিয়ে চলে যানবাহন। হাইড্রোজেন ও জ্বালানি কোষ এখন সচল রাখতে পারে গোটা শিল্পপ্রতিষ্ঠান! সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা জানি এসব পদ্ধতি ব্যয়সাপেক্ষ নয়। এর জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন নেই। বরং ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। এই নতুন উদ্ভাবনগুলো বাঁচিয়ে দিতে পারে শত কোটি টাকা, জোগান দিতে পারে চাকরির। 

তবে আজকের দিনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করাই যথেষ্ট নয়। নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে, আমরা সে লক্ষ্য পূরণে কেন ধীরগতিতে এগোচ্ছি? কেন কোমর বেঁধে লেগে পড়ছি না? আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। প্রকৃতি বিপর্যস্ত। সামনে অপেক্ষা করছে বিপর্যয়! 

এখন যদি সচেতন না হও, তবে এর ফল ভোগ করবে তোমাদেরই সন্তান। বিজ্ঞানীরা জানেন, এখানে কোনো প্রকার গড়িমসি করার অবকাশ নেই। বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাজনৈতিক নেতারাও অবশেষে এর গুরুত্ব অনুভব করতে পেরেছেন। শুধু পারেনি আমাদের সরকার। তারা কিনা প্যারিস পরিবেশ চুক্তি থেকে সরে এসেছে! 

ওয়াশিংটনের একদল মনে করে, জলবায়ু পরিবর্তন বলে কিছু নেই। আরেক দল বলে বেড়ায় চাঁদে পদার্পণ হয়নি, ওসব ভুয়া খবর! যাঁরা চাঁদে অভিযান মানেন না, তাঁদের দৌড় রেডিওর টক শো পর্যন্তই। গুটিকয় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের মধ্যে তাঁদের ভাবনার জগৎ সীমাবদ্ধ। কিন্তু যাঁরা জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকার করেন, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। তাঁরা প্রেসিডেন্ট কেনেডির মতো নন। আমাদের উৎসাহ দেন তো না-ই, উল্টো নিজেরাই সংশয়ের সাগরে হাবুডুবু খান। ১৯৬০ সালের সেই জনগণের মতো। যাঁরা মহাকাশ ভ্রমণের সময় তাৎক্ষণিক ব্যয়ের কথা ভেবেই ভিরমি খেয়েছিলেন। তাই এর দীর্ঘকালীন সুফল দেখতে পাননি। 

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। নইলে প্রথমে ধ্বংস হবে সামুদ্রিক জীব। দেখা দেবে খাদ্যাভাব। কারণ বহু লোক খাদ্যের জন্য সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। খরা ও ক্ষুধা থেকে জন্ম নেবে যুদ্ধ! উপকূলবর্তী জনপদ চলে যাবে সমুদ্রের তলে। ধ্বংস হবে খেত-খামার। ক্ষতি হবে ব্যবসার। ছড়িয়ে পড়বে নানা প্রকার রোগবালাই। 

তাই আসন্ন বিপদ প্রতিহত করতে আমাদের প্রতিষ্ঠান দিনরাত কাজ করে চলেছে। প্রতিষ্ঠানটির নাম ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস্ট। আমরা বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন শহর, রাষ্ট্র, এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও জলবায়ু সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দিয়ে আসছি। 

আজকের এই আনন্দঘন দিনে তোমাদের জানাতে চাই, আমরা জলবায়ুবিষয়ক নতুন এক প্রকল্প হাতে নিতে চলেছি। এটি একটি জাতীয় পর্যায়ের উদ্যোগ। এতে আমার প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করবে প্রায় পাঁচ শ মিলিয়ন মার্কিন ডলার! প্রকল্পের নাম ‘বিয়ন্ড কার্বন’ বা ‘কার্বনমুক্ত ভবিষ্যৎ’। আমাদের লক্ষ্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে আনা, পরিবেশবান্ধব ‘ক্লিন এনার্জির’ ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো। শতভাগ ক্লিন এনার্জিনির্ভর (দূষণমুক্ত জ্বালানি) অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্য পূরণে আমরা মূলত চারটি পন্থা অবলম্বন করব। 

প্রথমত, রাষ্ট্রীয় সহায়তা অর্জন। লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সকল প্রকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া। কাজটা অসম্ভব নয়। কেননা ইতিমধ্যে ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস্ট আর সিয়েরা ক্লাবের যৌথ উদ্যোগে সারা দেশ থেকে ২৮৯টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল ২০১১ সালে। 

দ্বিতীয়ত, নতুন কোনো গ্যাসভিত্তিক কারখানা যেন প্রতিষ্ঠা না হয়, তা নিশ্চিত করা। যদিও সেগুলো তৈরি হতে যত দিন সময় নেবে, তার আগেই ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে নবায়নযোগ্য শক্তি। আর কারখানাগুলো হয়ে পড়বে অচল। সময় অনুপযোগী। লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো শহর ইতিমধ্যেই প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক কারখানাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। সবাই নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুঁকছে। এমনকি নিউ মেক্সিকো, ওয়াশিংটন, ওয়াইও এবং ক্যালিফোর্নিয়াও লেগে পড়েছে ১০০ শতাংশ ক্লিন এনার্জি উৎপাদনের লক্ষ্যে। 

তৃতীয়ত, জলবায়ুর পরিবর্তনের পক্ষে যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো। তাঁরা হতে পারেন সরকারি পর্যায়ে কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, গভর্নর, আইন সভার সদস্য কিংবা মেয়র, তৃণমূল পর্যায়ের অ্যাকটিভিস্ট অথবা কোনো পরিবেশবাদী সংস্থা। আমরা তাদের সহায়তা করব। নৈতিক সমর্থন করব। সবাই একত্র হলে একসময় সরকার বাধ্য হয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে দেবে। তৈরি হবে দূষণমুক্ত বাসস্থান, প্রতিষ্ঠিত হবে বর্জ্যমুক্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ইলেকট্রিক যানবাহনের ব্যবহার বেড়ে যাবে। গণযোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হবে। তখন কম্বাস্টন ইঞ্জিন হয়ে পড়বে অকেজো। শিল্পবিপ্লবের স্মৃতিমাত্র! 

সবশেষে নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। কারণ, ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তর্কযুদ্ধে জেতার ক্ষেত্রে যতটা না বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন কাজে দেবে, তাঁর চেয়ে ঢের বেশি কাজে দেবে রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো। 

আমরা আমাদের দল ভারী করে যাব। স্বেচ্ছাসেবক ও অ্যাক্টিভিস্টদের পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনে সাহায্য করব। আমরা সফল হব, যদি তোমরা আমাদের সঙ্গে যোগ দাও। প্রতিবাদ করতে শুরু করো। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধের পক্ষে কাজ করো। সুযোগ পেলেই কড়া নাড়তে থাকো সম্ভাবনার দুয়ারে। নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতা, তোমাদের পরিবার ও বন্ধুদের এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাও। 

১৯৫০ সালে যখন আমরা চাঁদ বিজয়ে গিয়েছিলাম, সে সময় একটা কথা বেশ প্রচলিত ছিল। তা হলো, ‘যদি সমাধানের অংশ না হয়ে থাকো, তবে তুমি সমস্যার অংশ।’ আজ সত্যিকার অর্থেই ওয়াশিংটন একটা বিশাল সমস্যার হোতা! আমাদের কিন্তু সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। আমি আবার বলছি, একসময় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাধা ছিল বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের ঘাটতি। এখন হলো রাজনৈতিক অসহযোগিতা।

স্নাতকেরা, ভবিষ্যতে ক্লিন এনার্জি উৎপাদনে তোমরা সক্রিয় হও। নিজেদের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাও। একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে প্রয়োজন তোমাদের সহযোগিতা। তোমাদের সোচ্চার কণ্ঠ। তোমাদের ভোট। তোমরাই পারবে আমাদের পথ দেখাতে, যা ওয়াশিংটন পারেনি। মনে হতে পারে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করা সহজ নয়। এ যেন প্রথম চাঁদে পদার্পণের মতোই কষ্টসাধ্য। তবু আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। 

ইংরেজি থেকে অনুবাদ

শাহরোজা নাহরিন

সূত্র: এমআইটি নিউজ