কিছু অর্জন পদকের চেয়েও বড়

>গত বছর আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের জন্য প্রথম স্বর্ণপদক এনে দিয়েছিলেন আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী। আর এ বছর তিনি কাজ করেছেন বাংলাদেশ দলের ‘মেন্টর’ হিসেবে। কেমন হলো এবারের প্রস্তুতি? জেনে নিন তাঁর লেখা থেকে।

‘সকাল হয়ে গেছে, ঘুমাতে যাবি না?’ ভোর ছয়টায় সৌমিত্রের এই কথা শুনেই শুরু হলো গণিত ক্যাম্পে ঘুমানোর প্রস্তুতি। না না, তারা গণিতের প্রেমে মগ্ন হয়ে ঘুমকে বিসর্জন দেয়নি, যুক্তরাজ্যের সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস করতেই এই প্রচেষ্টা। স্বাভাবিক। কিছুদিন পরই এই কিশোরেরা যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেবে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও) বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরতে। 

এই নিয়ে ১৫তম বারের মতো বাংলাদেশ যোগ দেবে বিশ্বের সেরা এই মেধার লড়াইয়ে। অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত অর্জন ১টি স্বর্ণপদক, ৬টি রৌপ্যপদক, ২২টি ব্রোঞ্জ পদক এবং ২৭টি সম্মানজনক স্বীকৃতি পেয়েছি। গত ২৫ বছরে প্রথমবার অংশ নেওয়া দেশগুলোর মধ্যে আইএমওর হল অব ফেমে বাংলাদেশই সবার সামনে। তবে এই জন্য যে আমাদের দলের ৬ সদস্য অতিরিক্ত চাপ নিয়ে ফেলছে, তা নয়। 

‘আমি নির্দিষ্ট কিছুই আশা করছি না’, বলল গণিত দলের সদস্য দেওয়ান সাদমান হাসান। ‘অলিম্পিয়াডে বাকিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কথা চিন্তা না করে নিজে বেশি করে সমস্যা সমাধান করাই আমার লক্ষ্য।’ তার কথায় সম্মতি দিল টিমমেট আহমেদ ইত্তিহাদ। ‘আমি আগে ক্রিকেট খেলতাম, আর এখন অলিম্পিয়াডে যাচ্ছি—দুই ক্ষেত্রেই আমার মনে হয় সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তুতি যতই ভালো হোক না কেন, তোমাকে প্রতিযোগিতার দিনে পারফর্ম করতে হবে। তাই আমি কোনো নির্দিষ্ট পদকের আশা করে চাপ নিতে চাচ্ছি না।’ 

মানসিক চাপ বোধ হয় সবচেয়ে বেশি পড়ছে সৌমিত্র দাসের ওপর। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় ক্যাম্প করা ছেলেটি তার পরের বছরই নিজের জায়গা করে নেয় বাংলাদেশের দলে। এবারের বাংলাদেশ দলের মধ্যে এর আগে আইএমওতে যাওয়া একমাত্র সদস্য সে। ‘আমার সবচেয়ে বড় সুবিধা আমার অভিজ্ঞতা এবং দুর্বলতাও আমার সীমিত অভিজ্ঞতা’, জানাল সৌমিত্র। 

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে সমস্যাগুলো আসে গণিতের চারটি বিষয় থেকে—বীজগণিত, কম্বিনেটরিকস, জ্যামিতি ও সংখ্যাতত্ত্ব। বাংলাদেশ দলের দলনেতা ড. মাহবুব মজুমদার আশা করছেন, চারটি বিষয় থেকেই আমাদের শিক্ষার্থীরা অন্তত আইএমওর সহজ স্তরের সমস্যাটি সমাধান করতে পারবে। দলের মারুফ হোসেন অবশ্য সেই সমস্যাগুলো সমাধান করেও কঠিন সমস্যাগুলো থেকে কিছু পয়েন্ট তোলার ব্যাপারে আশাবাদী। সে বলছিল, ‘প্রথমবার অংশগ্রহণে তাতেই খুশি হব আমি।’ 

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া মাশরুর হোসেন ভূঁইয়া দলের সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য। তার প্রথম এবং শেষ (উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে যাওয়ার পর আইএমওতে আর অংশগ্রহণ করা যায় না) আইএমওর প্রস্তুতি সম্পর্কে সে জানাল, ‘সংখ্যাতত্ত্ব ও কম্বিনেটরিক্সে সীমাবদ্ধতা থাকলেও তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।’ গণিত দলের চূড়ান্ত বাছাইয়ে সর্বোচ্চ স্কোর করা আহসান আল মাহীর কম্বিনেটরিকস এবং জ্যামিতিতে ভালো করার আশা করছে। সে বলল, ‘অবশ্যই খালি হাতে ফিরব না।’ 

আমাদের কিশোরেরা গণিতের বিশ্বকাপে খেলতে যাচ্ছে। বাংলার টাইগাররা যেমন বাইশ গজে ব্যাট-বলের লড়াইয়ে সেরা দলগুলোর সঙ্গে সমানতালে টেক্কা দিয়েছেন, তেমনি হয়তো বাথ শহরে গণিত দলও বাংলাদেশের নাম স্থাপন করবে বিশ্বসেরাদের তালিকায়। 

এ বছর কেমন হতে পারে আমাদের ফলাফল? সত্যি কথা বলতে, আইএমওতে আমাদের অর্জন শুধু পদকের মানদণ্ডে বিচার করা যাবে না। এ বছর প্রথমবার বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় আয়োজিত হয় গণিত অলিম্পিয়াড, তাতে অংশগ্রহণ করে ৫০ হাজার শিক্ষার্থী। তারপর আঞ্চলিক ও জাতীয় গণিত উৎসবের মাধ্যমে বাছাই করা হয় দেশের সেরাদের। তাদের নিয়ে আয়োজন করা হয় জাতীয় ও বর্ধিত গণিত ক্যাম্প এবং লম্বা বাছাই প্রক্রিয়ার পর বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায় ছয়জন। এই দলকে এত দূর পৌঁছানোর পেছনে রয়েছে একাডেমিক টিমের রাত জেগে সমস্যা সমাধান ও খাতা দেখা, মুভারসদের (জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডের স্বেচ্ছাসেবকদের দল) দিনভর ছোটাছুটি, প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির দক্ষ ব্যবস্থাপনা। রয়েছে ডাচ্–বাংলা ব্যাংক ও প্রথম আলোর পৃষ্ঠপোষকতা। আমার আশা, আন্তর্জাতিক ময়দানে আমাদের গণিত দলের অর্জন সেই ৫০ হাজার শিক্ষার্থীকে স্বপ্ন দেখার অনুপ্রেরণা দেবে, যেন তারা প্রত্যেকে গণিতের মজা উপলব্ধি করে জীবনকে আরও সুন্দর করে তুলতে পারে।