প্রযুক্তি ভালো না মন্দ - সেই সিদ্ধান্ত আমাদের

>

মাইকেল ডেল। ছবি: সংগৃহীত
মাইকেল ডেল। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের অন্যতম বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডেল টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাইকেল ডেল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের (অস্টিন) সমাবর্তনে বক্তা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের এই ব্যবসায়ী, সমাজসেবী ও লেখক।

অভিনন্দন স্নাতকগণ। আজ তোমাদের আনন্দে আমার পরিবারও শামিল হয়েছে। আমার মেয়ে তোমাদের সঙ্গেই স্নাতক পাস করল, যা আমি নিজে করতে পারিনি। 

তোমরা জানো কি না জানি না, একসময় আমিও টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। এখানে ক্লাস করেছি বড়জোর দুই সেমিস্টার । এরপর পড়াশোনা দিলাম ছেড়ে! 

আসলে যত দূর মনে পড়ে, বরাবরই আমি সময়ের আগে সবকিছু শেষ করতে চাইতাম। ছেলেবেলার একটা ঘটনা বলি। 

একদিন ম্যাগাজিনের পাতা নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। হঠাৎ পেছনের পাতার একটা বিজ্ঞাপন আমার নজর কাড়ল। তাতে লেখা, সহজ এক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই আর মাধ্যমিকে পড়ার প্রয়োজন হবে না। অর্থাৎ, হাইস্কুল ইকুইভ্যালেন্সি টেস্ট। ভাবলাম, সুযোগ হাতছাড়া করা চলবে না! দিলাম আবেদন পাঠিয়ে। চিঠির সঙ্গে জুড়ে দিলাম বিজ্ঞাপনের কাটা অংশ। 

আমার পরিকল্পনা সঠিক। একেবারে নিখুঁত। কিন্তু বাদ সাধল আমার বয়স। মোটে আট বছর! 

সপ্তাহখানেক পর সেই প্রতিষ্ঠান থেকে লোক এসে হাজির! কেমন অবস্থা বলো! 

যা হোক, মাধ্যমিকে পড়তেই হলো। সময়মতোই মাধ্যমিক পাস করলাম। এলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছুদিন যেতে না–যেতেই ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া চাই! কারণ কিন্তু এই নয় যে আমার বাড়ি ছিল বেশ দূরে। আসল উদ্দেশ্য, ব্যবসা করব। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েই দারুণ এক ব্যবসা জমিয়ে ফেললাম। সে ব্যবসা যেন তরতর করে বেড়ে উঠতে লাগল। একপর্যায়ে মনে হলো, লেখাপড়া ব্যবসার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে! দুটোতে একযোগে মন দেওয়া কঠিন। আমাকে বাস্তবজীবনে নামতে হবে। সে জীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরে। 

ধরো, একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ভর্তি হয়েছে। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল, পড়াশোনা ছেড়ে দেবে। কেন? হোস্টেলের ভেতরেই যে তার রমরমা ব্যবসা। কী সেই ব্যবসা? দশ মেগাবাইটের হার্ডড্রাইভ কেনাবেচা? হ্যাঁ, আসলেই তাই। ভাবতে এখন অবাক লাগলেও এটুকুই ছিল আমার ব্যবসা। এ কাজটি আমাকে এমন এক পথ দেখিয়েছিল, যা ছিল বেশ মজার আর চ্যালেঞ্জিংও! এ কাজে এত সফলতা পাব, কল্পনাতেও আসেনি। 

পঁয়ত্রিশ বছর হলো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছি। জীবনের এই পর্যায়ে এসে তোমাদের বলতে চাই, আজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যা কিছু অর্জন করেছ, তা সামান্য নয়। এর মূল্য সীমাহীন। বাস্তবজীবনে তা অপরিহার্য! 

এ যুগে প্রত্যেকেই যেন ঘূর্ণির মতো ছুটছে! কারও মধ্যে স্থিরতা নেই, ধৈর্য নেই। এমন একসময়ে থেকেও তোমরা ধৈর্য ধরে পড়াশোনা শেষ করেছ। যা শুরু করেছিলে, তা আজ শেষ করলে। এটা সত্যি গর্বের বিষয়। আমার নিজেরই তো ধৈর্যশীলতার গুরুত্ব বুঝতে এতগুলো বছর লেগে গেছে! 

শুধু কি জ্ঞানার্জন? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তোমরা বন্ধুদের বিশ্বাস অর্জন করেছ। সম্মান পেয়েছ শিক্ষক বা গুরুর কাছ থেকে। এসবের যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, বিশ্বাস বা মর্যাদা অর্জন করতে অনেক সময় লাগে, কিন্তু খোয়াতে সময় লাগে না মোটেও!

এখন আমার ছেলেবেলার কথায় আসি। 

১৯৮২ সাল। হিউস্টনে আয়োজন করা হয়েছে জাতীয় কম্পিউটার সম্মেলন। সে সম্মেলনের যে দিকটি আমার বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তা হলো, ‘ব্যক্তিগত কম্পিউটারের’ (পার্সোনাল কম্পিউটার) ধারণা! তোমাদের বুঝতে হবে, সেটা ১৯৮২ সালের কথা। বেশ কিছুদিন আগেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার রাখতে হলে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হতো। কারণ, কম্পিউটার তখন ছিল বিশাল এক যন্ত্র! ওটার একাই একটা আস্ত ঘর দখল করে রাখত! তাই তো তখনকার দিনে, ‘ব্যক্তিগত কম্পিউটার’ নিয়ে ভাবনাচিন্তা ছিল এককথায় চমকপ্রদ! 

কে জানত, একদিন এই কম্পিউটার ঘিরেই গড়ে উঠবে বৃহৎ প্রযুক্তিশিল্প! 

আজ প্রযুক্তি অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। দ্রুত এর বিকাশ ঘটছে। এই ক্রমবিকাশের সঙ্গে আমরা তাল মেলাতে পারছি না। পারছে না আমাদের আইনকানুন। কর্মক্ষেত্রে মানুষের জায়গা দখল করে নিচ্ছে নানা যন্ত্রপাতি। বেশি দিন নেই, বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রজাতির তালিকা থেকে আমাদের নাম কাটা পড়বে! 

তাই প্রযুক্তি এখন অনেকের কাছেই ভীতির কারণ।

তবে আমি কিন্তু আশাবাদী! প্রযুক্তির ওপর আমার ভরসা আছে। কেন জানো? 

প্রথমত, এর এত সব ভয়াবহ দিক; তা সত্ত্বেও প্রযুক্তি কিন্তু ভালো কাজ করার ক্ষমতাও রাখে। আমরা দেখেছি, এই প্রযুক্তিই আমাদের ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখছে। জীবনের মান উন্নয়ন করছে। শুধু আমাদের না, পৃথিবীজুড়ে সবার জন্য মঙ্গল বয়ে আনছে। 

সে কারণেই আমার কোম্পানি ও পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন প্রযুক্তিবিষয়ক প্রকল্পে অর্থায়ন করে থাকে। এসব প্রকল্পের কাজ হলো আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে যুগ যুগ ধরে চলে আসা সব সমস্যার সমাধান করা! আমরা দেখেছি, কেবল একটা ব্যাংকিং অ্যাপ দিয়েই কোনো এক পরিবারের দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। তথ্যপ্রযুক্তির বড় বড় নেটওয়ার্ক এখন মেয়েদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে। আর খুদে স্যাটেলাইটগুলো? ওগুলো এখন নিমেষে খুঁজে দিতে পারে দাবানলের পর রয়ে যাওয়া বিষাক্ত ধ্বংসাবশেষ! 

তোমরা হয়তো জানো, ভবিষ্যতে প্রযুক্তির কী কী চমক আসতে পারে। স্বনিয়ন্ত্রিত যানবাহন, ড্রোন দিয়ে মালামাল পরিবহন ইত্যাদি আরও কত–কী! কিন্তু বাস্তবিক অর্থেই অগ্রগতি হলো জন্মগত অন্ধত্ব বা বধিরতা দূর করতে পারা। কিংবা পক্ষাঘাতের চিকিৎসা। আর তা সম্ভব হতে পারে রোবটিকস, নিউরাল ইমপ্ল্যান্টস বা স্নায়বিক অঙ্গ সংস্থাপন অথবা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে। 

আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে যখন আমার কোম্পানি ডেল যাত্রা শুরু করেছিল, তখন আমি এসব কল্পনাও করতে পারতাম না! এখন ইন্টারনেট চলে এসেছে। সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। ডিজিটাল তথ্য জমা রাখার জন্য রয়েছে ক্লাউড। এখন ডিজিটাল তথ্য জমা রাখার পরিধিও বেড়েছে বহুলাংশে। 

আমরা আরও উন্নত হতে চাই। হতে চাই সফল। এর জন্যই প্রতিনিয়ত আমরা কিছু না কিছু শিখছি, জানছি, পরিবর্তন আনছি। প্রয়োজনে নিজেদের করছি রূপান্তর! নিজেদের ক্রমবিকশিত করছি। জিইয়ে রাখছি কৌতূহল! 

এবার বলব দ্বিতীয় যে কারণে আমি প্রযুক্তি নিয়ে আশাবাদী। 

দেখো, প্রযুক্তি নিজে কিন্তু নিরপেক্ষ। না ভালো, না মন্দ। এটি শুধু পারে মানবক্ষমতাকে শত গুণ বাড়িয়ে দিতে কিংবা মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু দিন শেষে কোনটি ঘটবে, সে সিদ্ধান্ত আমাদের। সে সিদ্ধান্ত তোমাদের। 

এ জন্যই তো আমি আশাবাদী! কারণ, তোমাদের প্রজন্ম দেখিয়ে দিয়েছে তোমরা ন্যায় ও পক্ষপাতহীন বিচারের পক্ষে। সেটা যে কারও ক্ষেত্রেই হোক না কেন! 

বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করবে, সেই মনোবল আছে তোমাদের। আর আকাঙ্ক্ষা আছে নিজ উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজসেবা করার। এটাই তো মানবতার মূলমন্ত্র! 

টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে যে শিক্ষা তোমরা পেয়েছ, তার মূলে রয়েছে এসব মূল্যবোধ। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে এসব মূল্যবোধ মেনে চলা সহজ কথা নয়। এর জন্য ভয়কে জয় করে সামনে এগোতে হয়। ঝুঁকি নিতে হয়। 

অনেকেই জানে না তারা কত কিছু করতে সক্ষম। কারণ, তারা ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। অনেকেই সত্যের পক্ষে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। যদি তাদের ধারণা ভুল হয়! 

কিন্তু এভাবে পৃথিবীকে বদলানো যায় না। যদি ঝুঁকি না নাও, তাহলে সঠিক জায়গায় নিজের মেধাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে না।

স্নাতকেরা, এত দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই তোমরা মেধাকে কাজে লাগিয়েছ। এখন পৃথিবীর জন্য কাজে লাগাতে হবে। কারণ, পৃথিবীর তোমাকে প্রয়োজন। 

আজ টেক্সাসসহ সমগ্র পৃথিবী তোমাদের মুখ চেয়ে আছে। তাই পা বাড়াও, ঝুঁকি নাও। 

নিজের ও অন্যের জীবনে পরিবর্তন আনো। বিনিময়ে যা পাবে, তা হয়তো তুমি কখনো কল্পনাও করোনি। 


ইংরেজি থেকে অনুবাদ: শাহরোজা নাহরিন, সূত্র: ইউটি নিউজ