যেভাবে প্রকৃত বন্ধু হব

ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে এসে ক্যাম্পাসে এক হয় শিক্ষার্থীরা, গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে এসে ক্যাম্পাসে এক হয় শিক্ষার্থীরা, গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে

ক্লাসরুমের সামনে অনেক মানুষের জটলা দেখে এগিয়ে যায় ফাহাদ (ছদ্মনাম)। একটু এগোতেই ভীষণ অবাক হয় সে। দুটি ছেলে মারামারি করেছে, একজনের গাল-কপাল কেটে খুব খারাপ অবস্থা, আরেকজন তখনো উত্তেজিত স্বরে কথা বলে যাচ্ছে। ফাহাদ অবাক হয়ে দেখে, এ দুজনের একজন তার কলেজজীবনের বন্ধু দুর্জয় (ছদ্মনাম)। ফাহাদ ও দুর্জয় বেশ ভালো বন্ধু ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভিন্ন বিভাগে ভর্তি হওয়ায় তাদের মধ্যে খানিকটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দুর্জয়কে তো সে খুব ভালোভাবে চেনে। ভীষণ শান্ত প্রকৃতির ছেলে ছিল দুর্জয়, কথাও কম বলত। তাই দুর্জয়ের হঠাৎ পরিবর্তন দেখে উদ্বিগ্ন হয় ফাহাদ, তখনই গিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, কী হয়েছে ওর? কিন্তু ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দুর্জয়ের রুদ্রমূর্তি দেখে থেমে যায় সে। আশপাশের মানুষজনের কাছ থেকে জানতে পারে, দুর্জয় একটি ছেলেকে গ্রামের কলেজ থেকে এসেছে বলে বারবার টিটকারি দিচ্ছিল, সেখান থেকেই মারামারির সূত্রপাত।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘যে কয়টি কারণে তরুণদের মধ্যে সহিংস উগ্রবাদী আচরণ দেখা যায়, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো সামাজিক অবস্থানের পার্থক্য মানতে না পারা।’ ফাহাদের মতো অনেকেই হয়তো বন্ধুদের মধ্যে সামান্য ভিন্নতা বা বৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করে সহিংস আচরণ বা উগ্রবাদী মানসিকতার প্রকাশ লক্ষ করেছেন। কখনো এ প্রকাশভঙ্গি হয় ক্ষুদ্র পরিসরে স্বল্পমাত্রায়, কখনো আবার হয়ে ওঠে বিশাল কোনো ক্ষতির কারণ। কিন্তু বন্ধু যদি উগ্রবাদী ধারণা পোষণ করে, সহিংসতার পথ বেছে নেয়, তখন কী করা উচিত, তা আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না। হয়তো ফাহাদের মতো আপনিও ভাবেন, এটা বন্ধুর নিজস্ব সমস্যা, তর্কে জড়ানোর চেয়ে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

বন্ধুর অবস্থানে নিজেকে দাঁড় করিয়ে কিন্তু বোঝার চেষ্টা করা যায়, তার এমন সহিংস আচরণের কারণ কী। এ ব্যাপারে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাতিমা নুজহাত কাদেরী বলেন, ‘আমার কলেজেই একজন বন্ধু ছিল, যার মধ্যে কিছু সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি ছিল। কিন্তু সেটি আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং আলাপ করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, পারিবারিক রক্ষণাত্মক পরিবেশের সূত্র ধরেই আচরণে এসব বিষয় চলে এসেছে।’ বন্ধুর পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি কারণগুলো যে এমন মানসিকতা গড়ে তুলতে পারে, তা বুঝতে শেখা ভীষণ জরুরি।

কারও মধ্যে উগ্রবাদী, সাম্প্রদায়িক ধারণা দেখলে তাকে এড়িয়ে চলতে হবে—এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মাহজাবীন হক বলেন, ‘একটি মানুষ কখনো কোনো নির্দিষ্ট কারণে পুরোপুরি খারাপ হয়ে যায় না। তাই বন্ধুর সাম্প্রদায়িক মন্তব্য শুনে তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু কোরো না। বরং মুক্ত আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করো।’

বন্ধুর সহিংস আচরণ, অন্যের প্রতি আক্রমণাত্মক হওয়ার প্রবণতাকে কোনো অবস্থাতেই বাহবা দেওয়া যাবে না। সে কথা মনে করিয়ে দিয়েই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নওশিন শহীদ বলেন, ‘ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিন্নতাকে মানতে না পেরেও বন্ধুদের মধ্যে সহিংসতার চিত্র আমি দেখেছি। এ ক্ষেত্রে অনেক বন্ধু একটি নির্দিষ্ট পক্ষ বেছে নিয়ে তাকে বাহবা দেয়। কিন্তু আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে বন্ধুটির সঙ্গে আলোচনা করা উচিত, তাকে বোঝানো উচিত কেন এমন আচরণ অনর্থক। কিন্তু কখনোই তাকে প্রশ্রয় দেওয়া বা তার প্রতি সমর্থন দেখিয়ে তাকে উসকানি দেওয়া উচিত নয়।’

যাদের মধ্যে উগ্রবাদী মানসিকতা প্রকট হয়ে ওঠে, তারা নিজের আদর্শ-মূল্যবোধ-মতামত থেকে ভিন্ন যেকোনো কিছুকেই তুচ্ছ মনে করে। এমনকি নিজের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সহিংস পন্থা অবলম্বন করতেও দ্বিধা করে না। তাই মনে রাখতে হবে, কোনো অবস্থাতেই উগ্রবাদী মানসিকতার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সময় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো যাবে না। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাহমিদ উল ইসলাম বলেন, ‘কোনো বন্ধুর মধ্যে সহিংস মানসিকতা দেখা গেলে প্রথমেই বুঝতে চেষ্টা করি উগ্রবাদিতাটি কোন ধরনের এবং কীভাবে এ মানসিকতাটি ব্যক্তির মধ্যে গড়ে উঠেছে। তার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনার সময় চেষ্টা করি উত্তপ্ত তর্কে না জড়াতে। কারণ সেখান থেকে হিংসা-দ্বেষ বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো ফলাফল পাওয়া সম্ভব নয়।’

বন্ধুকে বোঝাতে হবে, মানুষে মানুষে ভিন্নতা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এ ব্যাপারে অধ্যাপক মাহজাবীন হক বলেন, ‘ভিন্নতার সৌন্দর্য বন্ধুকে বুঝতে শেখাও। যে বন্ধুটি ক্লাসের গারো বা সাঁওতাল মেয়েটিকে দেখে কটূক্তি করছে, তাকে বোঝাও যে এতে শুধু বিভেদের দেয়ালই বাড়ে, বরং মেয়েটির সঙ্গে কথা বললে একটি ভিন্ন জাতিসত্তার আচার-রীতিনীতি সম্পর্কে জানা যাবে। নতুন কিছু জানার সে আগ্রহটি ওর মধ্যে জাগাতে চেষ্টা করো। দেখবে একসময় সে শ্রেণি-ধর্ম-গোত্র-বর্ণের পার্থক্য ভুলে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে শিখে যাবে।’