ফেসবুকে নারীর অবমাননায় সাজা কী?

লুইকানের স্বপ্ন (মেয়ে), শিল্পী: নাজলী লায়লা মনসুর
লুইকানের স্বপ্ন (মেয়ে), শিল্পী: নাজলী লায়লা মনসুর

অপরাধ ও অমানবিক ঘটনার মধ্যে কোনো কোনো ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন তোলে। সচেতন মানুষ অপরাধের শিকার ব্যক্তির জায়গায় নিজের সন্তান বা নিজেকে বা পরিবারের সদস্য, বন্ধু, স্বজনকে ভেবে শিউরে ওঠেন। ৫ জুলাই রাজধানীর ওয়ারীতে সামিয়া আফরিন সায়মা নামে ছয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর শ্বাস রোধ করে হত্যার ঘটনাটি ছিল তেমন একটি। বাড়ির ভেতর, ও বাড়ির সীমানার বাইরে ওত পেতে থাকা ধর্ষকদের কথা ভেবে কন্যাশিশু আছে, এমন অভিভাবকেরা নতুন করে আবার দিশেহারা বোধ করেন। প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য বেছে নেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মকে, বিশেষ করে ফেসবুককে। ধর্ষণ নির্মূলে কড়া আইন চান, ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন।

তবে এর উল্টোও ঘটছে। ধর্ষণের জন্য মেয়েটিকে দায়ী করা হয়, তার পোশাককে টেনে আনা হয়। বোরকা পরা মাদ্রাসাছাত্রী কেন ধর্ষণের শিকার হয়? অথবা ছোট্ট শিশু? বৃদ্ধা? এমন প্রশ্নেও নিজেদের অবস্থান থেকে এক ইঞ্চিও সরে আসে না তারা। তবে এসব ছাপিয়ে আরেক ধরনের প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে, তা হচ্ছে অপরাধ করার ইচ্ছা প্রকাশ এবং অপরাধকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা।

সায়মা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর একজন ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘চারদিকে ধর্ষণ, ধর্ষণ আর ধর্ষণ!! মন চায় আমিও একটু করে দেখি না কেমন ট্যাশ লাগে।’ ওই ব্যক্তি লেখার সঙ্গে জিব দিয়ে সুস্বাদু খাবারের স্বাদ নেওয়ার ইমোজি ব্যবহার করেন। পোস্টের অ্যাক্টিভিটি জায়গায় লেখেন, ‘ফিলিং লেটস রেপ’।

কয়েকজন মাদ্রাসাশিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের কয়েকটি অভিযোগ গণমাধ্যমে আসার পর একজন লিখেছিলেন, ‘...উনারা জানেন কীভাবে কোন পরিস্থিতিতে ধর্ষণ করা জায়েজ। উনারা হালালভাবে এগুলো করেন...।’

নারীনেত্রী ও আইনজীবীরা বিষয়টিকে ভয়াবহ প্রবণতা হিসেবে মন্তব্য করেছেন। আইনজীবীরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের মন্তব্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে আইনে সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, কেউ নিজ উদ্যোগে ওই সব পোস্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বললেন, ‘ঘটনাগুলো ক্রমাগতভাবে ঘটেই চলেছে। রাষ্ট্রের এখন এগিয়ে আসা উচিত। বিষয়টি আইনজীবীদের দেখা উচিত। আমরা দেখতে পারছি, বুঝতে পারছি, কিন্তু কিছু করতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে জননিরাপত্তার জন্য যে দুটি আইন আছে (তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮), তার প্রয়োগ নিশ্চিত হওয়া দরকার। আইনগুলোয় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান আছে। তাহলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নেই কেন?’

রাশেদা কে চৌধূরী আরও বলেন, অপরাধ করার ইচ্ছাপ্রকাশকে অপরাধ হিসেবেই দেখা উচিত। নীতিনির্ধারকদের বিরুদ্ধে কটূক্তি করলে যদি ধরা যায়, তাহলে নারীর অবমাননা করলে ধরা যাবে না কেন? এ ক্ষেত্রে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো রুল দিতে পারেন। এটা এখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের জায়গায় চলে গেছে। যেভাবে বাড়ছে, তাতে যত দ্রুত সম্ভব তা সামাল দিতে হবে। তা না হলে বিষয়টি মহামারি আকার ধারণ করবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়বদ্ধতার অভাব, সর্বোপরি মানবিক বোধের অভাব থেকে ফেসবুকে যা ইচ্ছা তা-ই লিখে যাচ্ছেন কেউ কেউ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারাহ্ দীবা বললেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিজের ভাবনা প্রকাশের এক সহজ মঞ্চ। বড় পরিসরে নিজের মতপ্রকাশের কখনো সুযোগ পাননি—এমন ব্যক্তিরা এখানে নিজের ভাবনা প্রকাশ করছেন। হয়তো সেই ব্যক্তি যে পরিবেশে বড় হয়েছেন, সেখানে তিনি শেখেননি এ ধরনের মঞ্চে কীভাবে কথা বলা উচিত। তিনি হয়তো বাস্তব জীবনেও এভাবে নারীর প্রতি অবমাননাকর কথা বলে অভ্যস্ত, তাঁর চারপাশের মানুষও এমন। ফলে, বক্তব্য অপরাধমূলক বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর কি না বা নীচু মানসিকতার পরিচয় দেয় কি না, তা যাচাই করার মতো বোধশক্তি নেই তাঁর।

অপরাধের ইচ্ছা প্রকাশ করার পোস্ট ফেসবুকে দেখলে যে কারও ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করা উচিত বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী তানজীব উল আলম। বললেন, এ ব্যাপারে আইনে সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। তবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছা তা করা নয়। যাদের সুশিক্ষার অভাব রয়েছে, যারা মানুষকে শ্রদ্ধা করতে শেখেনি, যারা মনে করে নারীরা ভোগের বস্তু, তাদের পক্ষেই এ ধরনের ক্ষতিকর মন্তব্য করা সম্ভব। দুঃখজনক যে, দেশে এমন ধরনের নাগরিক তৈরি হচ্ছে।

আইন কী বলে?
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের উপকমিশনার (ডিসি) আলীমুজ্জামান বললেন, যে কেউ এ ধরনের পোস্টের ক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়ে থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে পারেন। তাহলে পুলিশ সেই জিডিটি তদন্ত করে আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগ নেবে। তবে কোনো ব্যক্তি এমন পোস্টের ব্যাপারে জিডি না করলে পুলিশ নিজ থেকে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না।

পুলিশ সদর দপ্তরের (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত সরকার জানালেন, থানায় অভিযোগ পেলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২৫ (১) (ক) ধারার মাধ্যমে পোস্টদাতা বা মন্তব্যকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ২৫ (১) (ক) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলে জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয়প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে তা হবে অপরাধ। এ ক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বললেন, ফেসবুকে যে যা ইচ্ছা তা-ই লিখছেন। আইনে এ ধরনের বিষয় কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, তা নিয়ে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনে সুস্পষ্ট ধারা সংযোজন করা প্রয়োজন। কারণ ধর্ষণের ইচ্ছা প্রকাশ করে নারীর প্রতি এমন অবমাননাকর মন্তব্য করা অপরাধ। দায়বদ্ধতা বলেও ব্যাপার আছে। তিনি বলেন, ‘এ অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এ ধরনের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় আমরা সমাজকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছি। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবাইকে এর দায় নিতে হবে।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ফেসবুকে এ ধরনের মন্তব্য বন্ধ করতে সচেতনতার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন। সচেতনতা বাড়লে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে পারে। নারীর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য রুখতে পারে। আর্মেনিয়ান-আমেরিকান সংগীত পরিচালক সের্জ তানকিয়ানের ভাষায় বলা যায়, সচেতনতা সমাজের মাথা থেকে সব ধরনের অবিচার দূর করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফারাহ্ দীবার মতে, যেহেতু কোনো ব্যক্তি অভিযোগ না করলে পুলিশ এই আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেয় না, তাই নারীর প্রতি অবমাননাকর কোনো পোস্ট চোখে পড়লে নারী সংগঠনগুলোরই উচিত পুলিশের কাছে অভিযোগ করা। কারণ, সুরক্ষার অভাব, বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে পরোক্ষ সমস্যায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলার ‘ঝামেলায়’ কেউ ব্যক্তিগতভাবে জড়াতে চান না।