এট্টা মুক তো, কথা কম কবা

গুরুপদ গুপ্ত। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
গুরুপদ গুপ্ত। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
>‘ও মানুষ, মানুষ, দুডো চোক আর দুডো কান, দেকপা আর শোনবা, এট্টা মুক তো, কথা কম কবা...’ কিংবা ‘বয়স আমার বেশি না ওরে টুকটুকির মা, খালি চুল কয়ডা পাইহে গেছে বাতাসে...’। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া আঞ্চলিক ভাষার দুটি গান। এই গান দুটির মতো এমন অসংখ্য গান লিখেছেন গুরুপদ গুপ্ত। এই গায়ক ও গীতিকবির কথাই রইল এখানে।

গানের কথায় পাওয়া মানুষ যেন তিনি। তাই শিল্পীজীবনের কথা বলতে গিয়ে ফিরে গেলেন কৈশোরের দিনগুলোতে। যে কৈশোরের বেশির ভাগ দিন গুরুপদ গুপ্তর কেটেছে ফসলের মাঠে। কাকডাকা ভোরে বেরোতেন গরুর দড়ি হাতে, কাঁধে থাকত লাঙল আর জোয়াল। জমি চাষ করতে যাচ্ছেন, তবু সঙ্গে রাখতেন কয়েক পৃষ্ঠা কাগজ আর একটা কলম। মনে যখন সুর এসে ভর করত, কথাগুলো প্রাণ পেতে চাইত। লিখে রাখতেন সেটুকু। দিনে লেখা কথাগুলো আপন মনে সুর করতেন রাতে।

গুরুপদ গুপ্ত এখন খুলনা বেতারের নিজস্ব দোতারাবাদক ও শিল্পী। তবে খুলনা-যশোর অঞ্চলে তাঁর পরিচিতি একজন গীতিকার ও সুরকার হিসেবে। এখনো আপন মনে লিখে চলেছেন একের পর এক গান। খুলনা, যশোর ও নড়াইল অঞ্চলের ভাষায় এরই মধ্যে তিনি তিন শর বেশি জীবনভিত্তিক আঞ্চলিক গান লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন। পাশাপাশি জারি, সারি, ভাটিয়ালি, অষ্টক, কীর্তন, লোকগীতি, পল্লিগীতিসহ অন্যান্য গানও লিখেছেন আরও তিন শর মতো।

সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর লেখা ও সুর করা  ‘ও মানুষ, মানুষ, দুডো চোক আর দুডো কান, দেকপা আর শোনবা, এট্টা মুক তো, কথা কম কবা’ আঞ্চলিক গানটি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আলোচিত হচ্ছে গানের কথা। ব্যতিক্রমী সুর ও উপস্থাপনার জন্য উপভোগ করছে শ্রোতারা।

গানটি তিনি কীভাবে লিখলেন? বলছিলেন সেই প্রেক্ষাপট, ‘খুলনা বেতারে বসে গান নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে গল্প করার সময় একজন সহকর্মী ‘কথা বেশি বলার’ প্রসঙ্গ তোলেন। সেই সূত্র ধরেই ‘কথা কম কবা’ গানটি বাঁধি।’ একই রকমভাবে পরিবেশ, পরিস্থিতি মিলিয়ে, চারপাশের দেখা থেকে জীবনভিত্তিক গান লেখেন তিনি।

‘বয়স আমার বেশি না ওরে টুকটুকির মা, খালি চুল কয়ডা পাইহে গেছে বাতাসে’, , ‘আমরা দুইজন মিলে ম্যাট্রিক পাস, মানে ও পড়িল ফোর পর্যন্ত আমি পড়িলাম ছয় কেলাশ’, ‘আজকালকের পোলাপান, বাপেরে কয় হুক্কা আন, মারে কয় কুটনি বুড়ি, বউরে কয় সোনার চান’, ‘যতই হোক গে বৃষ্টি খরা, ছাতি আমি ম্যালবো না, এডা আমার শ্বশুর বাড়িততে চুরি এরে আনা’—জনপ্রিয় এসব গানও তিনি চলার পথে দেখা এবং নিজের ও আশপাশের মানুষের জীবনবাস্তবতার নিরিখে লিখেছেন।

গুরুপদ গুপ্তর জন্ম ও বেড়ে ওঠা নড়াইল জেলার সদর উপজেলার রামনগরচর গ্রামে। সাত ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় গুরুপদ বড় হয়েছেন অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম করে। নিজের বাড়িতে, অন্যের জমিতে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে পড়ালেখাটা বেশি দূর এগোয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে গিয়েই চুকাতে হয়েছে পড়াশোনার পাট। তবে তাঁর বয়স যখন ১৫-১৬ বছর, তখন থেকেই কাজের ফাঁকে গান লেখা, সুর করা ও গাইতে শুরু করেন। বাবা অমৃত লাল গুপ্তও ছিলেন দোতারাবাদক ও ভাটিয়ালি গানের শিল্পী। বাবার হাতেই দোতারায় হাতেখড়ি। এরপর একে একে একতারা, দোতারা, খোল বাজানো শেখা। বেতারে চাকরি পাওয়ার আগপর্যন্ত তিনি বিভিন্ন যাত্রা দল, কীর্তন দল, গাজীর গানের দলে কাজ করেছেন। ঘুরেছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়।

আঞ্চলিক গান তিনি প্রায় লিখতেন। তবে সংখ্যাটা খুব বেশি নয়। একটি ঘটনা তাঁকে বেশি বেশি আঞ্চলিক গান রচনায় আগ্রহী করে তোলে। সেই গল্পও শোনালেন তিনি, ‘গান গাইতে বন্ধুদের সঙ্গে একবার সাতক্ষীরার কলারোয়ার হলদিপোতা গ্রামে গিয়েছিলাম। সেই আসরে একজন শিল্পী আঞ্চলিক গান করে আসর মাতিয়ে ফেলেন। সেই থেকেই ইচ্ছা জাগে আঞ্চলিক গান করব।’ এরপর থেকে আঞ্চলিক গানে আরও বেশি মনোনিবেশ করেন। এরপর বেতারে চাকরি করার সময় একবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে দেখেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় গান আছে, তবে খুলনার আঞ্চলিক গান তেমন সমৃদ্ধ নয়। এরপর থেকে খুলনা, যশোর ও নড়াইলের আঞ্চলিক ভাষায় গান লেখা শুরু করেন তিনি।

গুরুপদ গুপ্ত বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় শখ ছিল রেডিওতে গান করার। সেখানে একটা গান গাইতে পারলে জীবন সার্থক হবে ভাবতাম। মনে হতো, আমি তো লেখাপড়া জানি না। কীভাবে কী হবে। অবশেষে শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে যোগাযোগ করি খুলনা বেতারে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ বেতার খুলনায় শিল্পী হিসেবে চাকরি শুরু করি। এখন দোতারাবাদকের পাশাপাশি খুলনা বেতারের জনপ্রিয় চাষাবাদ অনুষ্ঠানে নিয়মিত গান করি।’

প্রতিভাবান এই শিল্পী খুলনা নগরের বয়রা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন। গান লেখা ও সুর করার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের দেশীয় বাদ্যযন্ত্রও তৈরি করেন তিনি। বললেন, ‘গান লিখি, গাই, নানান বাদ্যযন্ত্র বানাই। বেশি দূর লেখাপড়া শিখতে পারিনি। তাই এখন বেশি বেশি বই পড়ার চেষ্টায় থাকি।’

গান নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানাতে গিয়ে গুরুপদ বলেন, ‘মানুষের জন্য আমার লেখা, মানুষের জন্য আরও গান রেখে যেতে চাই। গান শুনে মানুষ হাসবে, কাঁদবে। তবে গানগুলো সংরক্ষণ করে রাখার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে না। আমার লেখা সব গান নিয়ে বই বের করতে পারলে ভালো হতো।’