মোবাইলের স্ক্রিন নয়, নিজের দিকে তাকাও

তিনবার প্রাইমটাইম এমি অ্যাওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড ও টনি অ্যাওয়ার্ডজয়ী মার্কিন অভিনেত্রী গ্লেন ক্লোজ। বয়স ৭০ পেরিয়েছে। অথচ এ বছরই টাইম সাময়িকী তাঁকে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী মানুষের একজন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। গত ১১ মে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব উইলিয়াম অ্যান্ড ম্যারির সমাবর্তন বক্তা ছিলেন তিনি।
গ্লেন ক্লোজ
গ্লেন ক্লোজ

আমি স্নাতক করেছি আজ থেকে ৪৫ বছর আগে। তখন পরিবারে আমিই ছিলাম প্রথম নারী, যার কলেজের ডিগ্রি আছে। আমার মা হাইস্কুল পেরোননি। ১৮ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়, আর বিয়ের দুই বছরের মাথায় সন্তান। আমার নানি-দাদি কিংবা তাঁদের মা-খালারা কেউই কলেজে যাননি। কারণ, তখনকার সময়ে এর চল ছিল না।

এদিকে দাদি থাকতেন টেক্সাসে। একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে এলেন আরেক শহরে। জুটিয়ে নিলেন ব্যাংকের চাকরি। ইচ্ছে, বোনকে কলেজে পড়াবেন।

আমার দুই বোনও কলেজে পড়েনি। সুতরাং বুঝে নাও, এখানে বক্তৃতা দেওয়াটা আমার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। 

তোমাদের প্রত্যেকেরই সহজাত কিছু নিজস্বতা আছে। আর এর ওপর তোমাদের আস্থা রাখতে হবে। প্রত্যেকেরই দৃষ্টিভঙ্গি আরেকজনের চেয়ে আলাদা। ঠিক তোমার মতো করে কেউ জগৎকে দেখে না। তোমার দৃষ্টিভঙ্গি স্বকীয় বা ব্যতিক্রম। মোটেই ফেলনা নয়। তাই অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করবে না। নিজের স্বকীয়তাকে মেনে নাও। এর ওপর বিশ্বাস রাখো। একে লালন করো।

আর যাদের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাস আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। সুযোগ পেলেই বন্ধুদের সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা দেবে। বিপদে-আপদে নিজেদের আগলে রাখবে। 

বলতে গেলে, আমি অত বিজ্ঞ লোক নই। কিন্তু নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। কারণ, কাজের ভেতর দিয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমার ৪৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে যা কিছু শিখেছি, তার কিছুটা আজ তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। 

নাটক বা সিনেমায় চরিত্রের ভেতর ঢুকতে হয়। সে সময় আমি খুঁজে বের করি, ঠিক কোথায় এর সঙ্গে আমার মিল আছে; কোথায় আমাদের দুজনের মানবীয় দিকগুলো এক। অন্যদিকে যদি এর খুঁত ধরতে গেলাম, তো এর প্রতি অবিচার করলাম।

সে জন্য নাটকের যেকোনো চরিত্রকে ভালোবাসতে হয়। কীভাবে ভালোবাসা যায়, সে উপায় বের করতে হয়। এভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চরিত্রের নানা দিক নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমি অন্যের প্রতি সহিষ্ণু হতে শিখেছি। অন্যের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হতে শিখেছি। আক্ষরিক অর্থেই, অন্যের জুতোয় পা দিয়ে তার জীবন বুঝতে চেয়েছি। তার চোখ দিয়ে দেখেছি গোটা দুনিয়া।

আমি তোমাদের বলব, তোমরাও অন্যকে বুঝতে শেখো, অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হও। এর জন্য চেষ্টা ও অনুশীলনের প্রয়োজন। প্রথমেই কৌতূহলী হতে হবে, কোনো ব্যক্তির কোনো বিশেষ আচরণের পেছনে কারণটা কী। এর চর্চা করতে করতেই তোমরা শিখে নেবে। 

তাই কাউকে দেখেই নাকচ করে দিয়ো না। তাদের খুঁত ধরার আগে নিজেকে তার অবস্থানে বসাও। তবেই তার অনুভূতি বুঝতে পারবে। 

ক্যারিয়ারের শুরুতে আমি ব্রডওয়ে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমার ড্রেসিংরুম ছিল মঞ্চ–লাগোয়া। ওদের মিউজিক্যালে আমি প্রধান চরিত্র ছিলাম না। ছিলাম সহ–অভিনেত্রী। দিনরাত নিজেকে নিংড়ে দিতাম, তাও আবার এমন একটা কাজের জন্য, যেখানে আমার পরিশ্রমকে যথার্থ মূল্যায়ন করা হতো না। 

নাটকটা ছিল দারুণ জনপ্রিয়। প্রত্যেক শোতে নিজেকে উজাড় করে দিতাম, মানসিক ও শারীরিক দুভাবেই। শো শেষে, প্রযোজকেরা ব্যাকস্টেজে আসতেন। তাঁরা আমার রুমের পাশ দিয়ে চলে যেতেন সোজা প্রধান চরিত্র যে ঘরে বসতেন, সেখানে। সেখানে খোশগল্প হবে।

দেখে আমার কষ্ট হতো। কারণ, তাঁরা আমাকে কদর করতেন না। আমার মনে হতো, আমার পরিশ্রমের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না।

তাই আমি জানি এ রকম আচরণ কতটা কষ্টদায়ক হতে পারে। আর তাই এখন আমি নিজে যখন কোনো কোম্পানির পরিচালক, দলের প্রত্যেকের দিকে আমি নজর রাখি, তাঁদের অবদান সম্বন্ধে জানি এবং সুযোগ পেলেই তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।

সিনেমার সেটে কেউ হয়তো নাশতার দিকটা তদারকি করেন। অভিনেতা বা পরিচালক খাবার পেলেন কি না, খেয়াল রাখেন। ফরমাশ খাটেন। ভারী ভারী কফিমগ টানাহ্যাঁচড়া করেন। এঁরা সবার শুরুতে অফিসে ঢোকেন, বাড়ি ফেরেন সবার শেষে। কি রোদ, কি বৃষ্টি, সব সময় তাঁদের কর্মব্যস্ততা।

এঁদের অবদানকেও মূল্যায়ন করতে হবে। এভাবে প্রত্যেকের কাজকেই স্বীকৃতি দিতে হবে। এটা দলের জন্য ইতিবাচক ফল আনে।

এখন কথা বলব সহানুভূতি নিয়ে।

আমার বোনপো ক্যালেন স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। তার বয়স যখন ১৭, তখন রোগটি ধরা পড়ে। এদিকে ক্যালেনের মায়ের বাইপোলার ডিজঅর্ডার। ১০ বছর আগে আমরা একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। নাম ব্রিং চেঞ্জ টু মাইন্ড। এর কাজ ছিল, মানসিক রোগ নিয়ে সামাজিক স্টিগমাগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্ল্যাটফর্মে মূলত এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকি। কারণ, একজন মানসিক রোগীকে তার রোগ যতটা না পীড়া দেয়, তার সমপরিমাণ পীড়া দেয় সমাজের ভ্রুকুটি বা অবজ্ঞা করার প্রবণতা। 

দুই দিন আগে আমি ক্যালেনের সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সামনে দুই হাজার লোক। ক্যালেন বক্তৃতা দিচ্ছে। একজন স্কিৎজোফ্রেনিক হিসেবে তার অভিজ্ঞতার কথা বলছে। সেদিন তার মনোবল দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। এ সময় দর্শকসারির কেউ একজন তাকে প্রশ্ন করে বসলেন, কোনো সুস্থ ব্যক্তি একজন মানসিক রোগীর মুখোমুখি হলে, তার কী করা উচিত? ক্যালেনের উত্তর ছিল, ‘তাঁর প্রতি সদয় হও।’

পৃথিবীতে একটা প্রজাতির টিকে থাকার জন্য সহানুভূতিশীলতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এডওয়ার্ড ও উইলসন বলেছেন, একটা প্রজাতি হিসেবে মানবজাতি অনেক দূর এগোতে পেরেছে। এর কারণ, আমরা সময়ের সঙ্গে একে অন্যের আবেগ–অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হতে শিখেছি।

আমাদের অন্যকে বোঝার ক্ষমতা বেড়েছে, কারণ আমরা অন্যের দিকে তাকিয়েছি। তাদের মুখোমুখি হয়েছি। তাদের চোখে চোখ রেখেছি। আসলে কিন্তু কারও চোখের দিকে তাকিয়েই তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। এটা যোগাযোগের ক্ষেত্রে দ্রুত ও শক্তিশালী উপায়। 

আমাদের সহানুভূতি বেড়েছে, কারণ ক্রমবিকাশের সূচনালগ্ন থেকে আমরা নিজেদের চোখে চোখ রেখেছি, ফোনের স্ক্রিনে নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যের সঙ্গে দূরত্ব যত বাড়বে, যখন একজনের চোখ আরেকজনের চোখ দেখতে পাবে না, তখন সহানুভূতিশীলতাও কমে যাবে।

যদি মুক্ত ও সফল সমাজ গড়তে চাও, নিজেদের দিকে তাকাও, মোবাইল স্ক্রিনে নয়।

 ইংরেজি থেকে অনুবাদ:  শাহরোজা নাহরিন

সূত্র: কলেজ অব উইলিয়াম অ্যান্ড ম্যারির অফিশিয়াল ওয়েবসাইট