'এই মমিন, তুমি নাকি সিগনেচার নকল করতে পারো?'

আমার প্রথম স্কুল প্রভাতি স্কুল। ঝিনাইদহ কেসি (কেশবচন্দ্র) কলেজের মধ্যে কলেজের শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত স্কুলটি পরিচালিত হতো। স্কুলটি সম্ভবত এখন আর নেই। ১৯৮১ সালে সেই স্কুলে কেজি শ্রেণিতে (আমরা বলতাম ছোট ওয়ান) ভর্তি হলাম। এক বছর সেখানে পড়েছি। খুব বেশি স্মৃতি মনে নেই। একটা ঘটনা শুধু মনে পড়ে। একদিন অঙ্ক ক্লাসে নিয়মিত শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে আমরা খুব হইচই করছিলাম। স্কুলের প্রধান শিক্ষক (সম্ভবত কলেজের শিক্ষক) এসে আমাদের ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত লিখতে দিলেন। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার আগেই স্যার অন্য কোনো ক্লাসে চলে গেলেন। আমি লেখা শেষ করে স্যারকে খুঁজতে বের হলাম। স্যার উঁচু কোনো শ্রেণিতে ক্লাস নিচ্ছিলেন। আমি সোজা সেই ক্লাসে ঢুকে স্যারকে আমার খাতা দিলাম। স্যার আমার হাত থেকে পেনসিলটা নিয়ে বড় করে ১০০ তে ১০০ লিখে দিলেন। স্যারের নাম মনে নেই। চেহারাও মনে নেই (সম্ভবত চশমা পরতেন)। কিন্তু সেই ১০০ তে ১০০ আমার মনে চিরস্থায়ী হয়ে গেল। শুধু একটা ক্লাস ওয়ার্কের জন্য ১০০ পাওয়া বিশাল অর্জন বটে।

এরপর ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলাম শিশুকুঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ে। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের প্রাঙ্গণে ক্যাডেট কলেজের তত্ত্বাবধানে স্কুলটি পরিচালিত হতো। এই স্কুলে রয়েছে আমার অনেক সুখস্মৃতি। বড় দুই ভাই এই স্কুলে পড়তেন। একে একে ছোট তিন মামাতো বোনও ভর্তি হলো এই স্কুলে। প্রতিবেশী আরও তিন–চারজন সমবয়সী ছিল একই স্কুলে। একসঙ্গে সবাই স্কুলে যেতাম। বিনা টিকিটে সবাই পাবলিক বাসে চড়ে স্কুলে যেতাম। কোনো ড্রাইভার/হেলপার বাসে বিনা পয়সার যাত্রী বাসে ওঠাতে না চাইলে স্থানীয় গুরুজনেরা ওদের ধমক দিয়ে আমাদের বাসে উঠিয়ে দিতেন। সারা পথ হইচই করতে করতে স্কুলে যেতাম। স্কুল ছুটি হলেও সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরতাম না। প্রিয় বন্ধু সুমন, মেহেদী, নান্নু, মানবেন্দ্র আর কয়েকজন মিলে অনেকক্ষণ ধরে খেলে আর গল্প করে তারপর বাড়ি ফিরতাম। ফেরার সময় আমাদের বাহন ছিল বাইসাইকেল। প্রধান সড়ক দিয়ে যেসব সাইকেল আরোহী যেতেন, তাঁরা ছিলেন আমাদের লক্ষ্য। অনেকে স্বেচ্ছায়, অনেকে বাধ্য হয়ে আমাদের লিফট দিতেন। অনেক সময় একসঙ্গে পাঁচ–ছয়জনের টানাটানিতে সাইকেল আরোহী হুড়মুড় করে রাস্তায় পড়ে যেতেন। কিন্তু তারপরও আমাদের হাত থেকে মুক্তি মিলত না!

ভালো ছাত্র হওয়ার কারণে শিশুকুঞ্জে সব শিক্ষক আমাকে চিনতেন এবং স্নেহ করতেন। শাহজান স্যার অঙ্ক করাতেন। সিরিয়াস টাইপের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তারপরও তাঁর স্নেহ বোঝা যেত। স্কুলে প্রিয় বন্ধু ছিল সুমন। ওর সঙ্গে ছিল গলায়-গলায় ভাব। আবার একটুতেই দুজনের মধ্যে ঝগড়া মারামারি লেগে যেত। একদিন কী কারণে সকালে স্কুলে গিয়েই আমাদের মারামারি লেগে গেল। সে তুমুল মারামারি। ক্লাসের সবার হর্ষধ্বনির মধ্যে একপর্যায়ে আমরা মেঝেতে জড়াজড়ি করে গড়াগড়ি খাচ্ছি, এমন সময় স্যার চলে এলেন। আমরা দুজন স্যারকে বললাম, স্যার আমরা শক্তি পরীক্ষা করছিলাম। স্যারের মতো সিরিয়াস মানুষের কাছ থেকে এত সহজে নিষ্কৃতি পাব, ভাবিনি। কিন্তু স্যার হেসে দিয়ে বললেন, যাও সিটে গিয়ে বসো। গৌতম স্যার স্কুলে যোগ দিলেন আমরা যখন ক্লাস থ্রিতে। ইংরেজির শিক্ষক। চমৎকার বাচনভঙ্গি। আমাদেরও প্র্যাকটিস করাতেন। একবার অন্য কোনো ক্লাস চলার সময় আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন ক্লাস সিক্সে। সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন Alphabet কাকে বলে। আমি বলার পর আমাকে বললেন চলে যেতে। পরে বড় ভাইদের কাছে শুনেছিলাম, কীভাবে তারা বলতে না পারায় ক্লাস থ্রিতে পড়া আমাকে দিয়ে তাদের লজ্জা দিয়েছিলেন। স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন ইসলাম ম্যাডাম (পরবর্তী সময়ে ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় আমাদের প্রিয় শিক্ষক নুরুল ইসলাম স্যারের স্ত্রী)। চমৎকার ব্যক্তিত্ব। ম্যাডাম পড়াতেন উঁচু ক্লাসে। কিন্তু আমাদের অনেক স্নেহ করতেন। অ্যাসেম্বলির সময় অনেক সুন্দর সুন্দর উপদেশ দিতেন। একদিন ক্লাসের সময় পানি খেতে বের হয়েছি। পানি খেতে যেতে হতো খেলার মাঠ পেরিয়ে একটা টিউবওয়েল বসানো ছিল সেখানে। টিউবওয়েল চেপে হাত জোড় করে আঁজলা ভরে পানি খেতে হতো। পানি খেয়ে ফিরছি, এমন সময় দেখি ম্যাডাম স্কুল ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। সালাম দিতেই মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। ম্যাডামের কাছ থেকে এই আদরটুকু পাওয়া ছিল অনেক কিছু। আরেকবার মিলাদুন্নবী উপলক্ষে স্কুলে মহানবীর জীবনের ওপর বক্তৃতা প্রতিযোগিতা। আমি আর আমার বন্ধু নান্নু প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। বড় বোনের রচনা বই ঘেঁটে ঘেঁটে আমি চমৎকার এক বক্তৃতা দাঁড় করিয়ে ফেললাম। কিন্তু আমি বক্তৃতা শুরু করতেই দেখি, দুই বিচারক নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল। ম্যাডাম হঠাৎ করে দুই শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘শুনছেন আপনাদের ছাত্র কী বলে?’ ম্যাডাম আমাকে আবার শুরু করতে বললেন। ফলাফলে আমরা দুই বন্ধু যৌথভাবে প্রথম।

১৯৮৬ সালে ক্যাডেট কলেজে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদের আগমন উপলক্ষে ঠিক হলো আমাদের স্কুলের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ‘পথের ধারে অবহেলায় যাদের কাটে সকল সময়...’ গাইতে গাইতে ফুল দিয়ে প্রেসিডেন্টকে বরণ করব। প্রধান শিক্ষক নবকুমার বিশ্বাসের ইচ্ছা, আমি লাইনের প্রথমে দাঁড়াব এবং প্রেসিডেন্টের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেব। আমার গানের গলা শুনে গানের শিক্ষক কিছুতেই আমাকে প্রথমে দাঁড়াতে দিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু প্রধান শিক্ষকের ইচ্ছারই জয় হলো। শেষে লজ্জায় আমি সে অনুষ্ঠান বর্জন করি।

ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার সময় আককাস স্যার আমাদের কোচিং করাতেন। অনেক যত্ন করে পড়াতেন। ছুটির দিনে কোচিংয়ের সময় আমাদের জন্য শিঙাড়া অথবা জিলাপি কিনে আনতেন। নিয়ম ছিল রাতে ১০টা পর্যন্ত বাসায় পড়াশোনা করার। শীতের রাতে ১০টা পর্যন্ত পড়া ছিল অনেক কষ্টের। কিন্তু মাঝেমধ্যেই স্যার বাড়িতে বাড়িতে চেক করতে আসতেন। আমার বাড়ির সবারও সে কথা জানা ছিল। তাই ঘুম ঘুম এলেও রাত ১০টা পর্যন্ত পড়ার টেবিলে বসে থাকা লাগত। সবচেয়ে কষ্ট লাগত যে রাতে টিভিতে ‘দ্য এ টিম’ দেখানো হতো। বাড়ির সবাই যখন সে সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় সিরিয়ালটি দেখছে, তখন আমি একা পড়ার টেবিলে। পড়ায় কী আর মন বসে! একরাতে অনেক সাহস করে চলে গেলাম টিভিরুমে। পেট ব্যথার কথা বলে বিছানায় শুয়ে ঘুমের ভান করে টিভি দেখতে লাগলাম। এমন সময় স্যারের আগমন। প্রিয় ছাত্রের এমন অধঃপতন দেখে স্যার খুব রেগে গিয়েছিলেন মনে হয় না, বরং আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে কিছুক্ষণ হাসাহাসি করে সবার সঙ্গে বসে সিরিয়াল দেখে বাসায় ফিরেছিলেন। বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্টের পর দেখা গেল, আমাদের স্কুল থেকে দুজন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। আমি আর আমার বন্ধু জাহিদ। কিন্তু জাহিদ তালিকার প্রথম আর আমি দ্বিতীয়। মনের দুঃখে আমি কেঁদে দিলাম। স্যার এসে আমার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে বললেন, ‘পাগল নাকি এই ছেলে? এত ভালো রেজাল্ট করে কেউ কাঁদে?’ স্যারের কথা শুনে আমার মন কিছুটা শান্ত হলো।

১৯৮৫ সালে মায়ের অসুস্থতার কারণে বড় আপা এসে আমাকে কুমিল্লা নিয়ে গেলেন। সেখানে ভর্তি হলাম কুমিল্লা ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল ও কলেজে। এই স্কুলে আমি ক্লাস ফোরের শেষ টার্ম আর ক্লাস ফাইভের প্রথম টার্ম পড়ি। এই প্রথম স্কুলে লাইব্রেরি ক্লাস পেলাম। লাইব্রেরিতে ঢুকতেই রক্তে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যেত। কত কত বই। ছোট শ্রেণিগুলোর জন্য লাইব্রেরিয়ান স্যার কিছু বই টেবিলে রেখে যেতেন। আমরা যার যার ইচ্ছামতো সেখান থেকে বই বেছে নিতাম। অনেকে বসে বসে গল্প করত। কিন্তু আমি গোগ্রাসে বই পড়তাম। ৪০ মিনিট যে চোখের পলকে কখন শেষ হয়ে যেত, টেরই পেতাম না। বেশির ভাগ সময় কোনো একটা বইয়ের শেষ কয়েকটা পৃষ্ঠা পড়া বাদ থেকে যেত। স্যার আমার ব্যাকুলতা দেখে একদিন বললেন, ‘আচ্ছা তুমি বই শেষ করে তার পর যাও।’ কিছুদিন পর থেকে স্যার আমার জন্য বই বাছাই করে রেখে দিতেন। স্যারের নাম কখনো জানা হয়নি। আরেকজন স্যার ছিলেন সমাজবিজ্ঞানের। স্যারের নামও ভুলে গেছি। অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। ক্লাসে পড়ানোর বাইরে কোনো কথা বলতেন না। বার্ষিক পরীক্ষার সময় কোনো একটা পরীক্ষার পর বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। দেখি উনি আরেক স্যারের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। স্কুলে আমি নতুন বলে তেমন কেউ আমাকে চিনত না। স্যার আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পরীক্ষা কেমন হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘ভালো।’ স্যার অন্য শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ছেলেটা অনেক মেধাবী। এই বয়সেই নিজের মতো করে উত্তর লেখে।’

১৯৮৮ সালে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হলাম ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে। ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকদের জীবন বড়ই কঠিন। ক্লাসে পড়ানো ছাড়াও সারা দিনই ক্যাডেটদের বিভিন্ন কার্যক্রমে তাদের ডিউটি করা লাগে। আর সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশ থেকে আসা ১২ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সী তুমুল মেধাবী ৩০০ কিশোরের অভিনব সব দুষ্টুমি সামলাতে হয় তাঁদের। তাই ক্যাডেটদের সঙ্গে শিক্ষকদের থাকে এক অম্লমধুর সম্পর্ক। আর ক্যাডেটদের সাফল্যে শিক্ষকেরা আমাদের মা–বাবার মতোই গর্বিত হন। ৩০–৪০ বছর পরে দেখা হলেও তাঁরা আমাদের ঠিকই চিনতে পারেন। আর কলেজে কী কী করতাম, সব ঠিকঠাক বলে দেন।

ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে নুরুল ইসলামের কথা। অসম্ভব অনাড়ম্বর, নিরাসক্ত, জ্ঞানী আর তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু সমাজ, ধর্ম, ইতিহাস, সাহিত্য—সব বিষয়ে স্যারের ছিল অসম্ভব পাণ্ডিত্য। শেক্‌সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ থেকে গড়গড় করে আওড়াতেন। সম্ভবত আমরা ক্লাস টেনে পড়ার সময় স্যার অবসরে যান। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি নিজের জীবনের স্মৃতি আর জীবনচেতনা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন, যা আমাদের মনে গভীর রেখাপাত করে। শেষ ক্লাসে স্যার আমরা ক্লাস সেভেন থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত কে কোন ডেস্কে বসেছি (প্রত্যেকেরই এর মধ্যে চার–পাঁচবার ডেস্ক পরিবর্তন হয়েছে) তা সব ঠিকঠাক বলে দিয়ে আমাদের চমকে দিয়েছিলেন। স্যার অবসরের পরে ঝিনাইদহ থাকতেন। স্যারের সঙ্গে অনেকবার দেখা করার কথা ভেবেছি, কিন্তু কেন যেন হয়ে ওঠেনি। অনেক বছর হলো স্যার ও ম্যাডাম দুজনই মারা গেছেন। এখন আক্ষেপ হয়, কেন স্যার আর ম্যাডামের কোনো খোঁজ রাখিনি।

আরেকজন মেধাবী এবং অত্যন্ত স্মার্ট শিক্ষক ছিলেন ফজলুল করিম স্যার। ক্যাডেটদের দুষ্টুমি অনেক শিক্ষকই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন। কিন্তু ফজলুল করিম স্যারের হাতে পড়লে কোনো নিস্তার ছিল না। স্যার ইতিহাস পড়াতেন। তাই ক্লাস এইটের পরে স্যারের ক্লাস করার সুযোগ হয়নি। কিন্তু কলেজের বিভিন্ন আন্তহাউস প্রতিযোগিতায়, যেমন কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ডিসপ্লে, নাটক, দেয়ালপত্রিকা, বিতর্কে আমাদের হাউসের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সেই সুযোগে স্যারের অনেক কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। এত বুদ্ধিমান আর এত উদ্যোগী শিক্ষক আমার জীবনে আসেননি। একবার স্যারের ওপর রাগ করে আমাদের কয়েকজন রাতে স্যার যখন হাউস পরিদর্শনে এসেছেন, স্যারের সাইকেলের হাওয়া ছেড়ে দিল। স্যার সাইকেল হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরলেন। পরদিন দেখা হলে স্যার বললেন, ‘কাল রাতে বাসায় ফেরার সময় দেখি সাইকেলের হাওয়া নেই। মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল। হেঁটে হেঁটে বাসার দিকে রওনা দিলাম। একসময় রাস্তায় দেখি বকুল ফুল পড়ে আছে। কত দিন পর বকুল ফুল বিছানো রাস্তা দিয়ে হাঁটলাম। কিছু ফুল তোমাদের ম্যাডামের জন্য নিয়ে গেলাম। দেখো সাইকেলে করে ফিরলে হয়তো এই অভিজ্ঞতা কখনোই আর হতো না। জীবনে খারাপ কিছুর পেছনে হয়তো ভালো কিছু লুকিয়ে থাকে!’ স্যারের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিছুদিন আগেও দেখা হতো। একেবারে প্রিয় বন্ধুর মতো ব্যবহার।

শাহিদা ম্যাডাম ছিলেন বাংলার টিচার। বাংলায় বরাবরই ভালো ছিলাম আমি। তাই ম্যাডামের প্রিয়পাত্রদের একজন ছিলাম। ক্লাস ইলেভেনে ম্যাডামের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়। কলেজ থেকে একটা ত্রৈমাসিক পত্রিকা বের হতো সাইক্লোস্টাইল করা। ক্যাডেট এবং শিক্ষকদের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ নিয়ে। সেবার দায়িত্বে ছিলেন ম্যাডাম। ঠিকমতো পত্রিকা বের করা নিয়ে ম্যাডাম খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু আমি দুই সপ্তাহ অনেক খাটাখাটুনি করে ঠিক সময়েই সুন্দর পত্রিকা বের করে ফেললাম। অনেক খুশি হয়েছিলেন ম্যাডাম। আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘অনেক বড় হও।’ একটা কাজ সব সময় করতাম আমি। বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষায় রচনার মধ্যে নিজে নিজে কবিতা বা কোটেশন লিখে বিখ্যাত কোনো কবি কিংবা লেখকের নামে চালিয়ে দিতাম। হয়তো একটা লাইন কিংবা ভাবার্থটুকু মনে আছে। বাকিটুকু মনের মাধুরী দিয়ে লিখে ফেলতাম। দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার এক ঈর্ষাপরায়ণ বন্ধু আমার পরীক্ষার খাতা ম্যাডামের কাছে নিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম আপনি মমিনকে হাইয়েস্ট মার্ক দিছেন। ও তো নিজে নিজে কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ আর শামসুর রাহমানের নাম বসায়ে দেয়।’ ম্যাডাম বসেছিলেন, ‘তুমিও চেষ্টা করে দেখো। এমন কবিতা যদি লিখতে পারো যে আমরা বুঝতে না পারি তোমার লেখা, তাহলে তো খুবই খুশির কথা।’

ক্যাডেট কলেজের কঠোর রুক্ষ জীবনের মধ্যে নাজনীন করিম ম্যাডাম (ফজলুল করিম স্যারের স্ত্রী) ছিলেন স্নিগ্ধবৃষ্টির পরশের মতো। যত কিছু আবদার, আমরা ম্যাডামের কাছে করতাম। অসম্ভব স্নেহময়ী আর নরম মনের ছিলেন। ঠিক মায়ের মতো তাঁকে বলা যাবে না, ম্যাডাম ছিলেন বড় বোনের মতো। সবার জন্য তাঁর ছিল অসম্ভব মমতা। ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় একবার আমাকে তাঁর রুমে ডাকলেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘এই মমিন, তুমি নাকি খুব ভালো সিগনেচার নকল করতে পারো? (বন্ধু এবং অনেক সিনিয়রের প্র্যাকটিক্যাল খাতায় আমার সিগনেচার ছিল, কেউ কখনো ধরা পড়েনি। নিজের খাতায় অবশ্য এই কাজ করার প্রয়োজন পড়েনি।)’  আমি অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, ‘কে বলেছে ম্যাডাম, এই সব মিথ্যা কথা।’ ম্যাডাম হেসে দিয়ে বললেন, ‘থাক তোমাকে আর অভিনয় করতে হবে না। এই দেখো আমি তো এবার হেড এক্সামিনার। একজন টিচার ছয়টা মার্কশিটে সিগনেচার মিস করে গেছেন। এখন আমি এটা এভাবে বোর্ডে পাঠালে ওই বিচারককে বোর্ডে ডেকে পাঠাবে সিগনেচার নেওয়ার জন্য। আর লাল দাগ পড়লে পরের বছর খাতা দেখার সুযোগ না–ও পেতে পারেন।’ এ ক্ষেত্রে কী আর না বলা যায়? আমার দক্ষতার নিদর্শন ম্যাডামকে দেখাতেই হলো! ম্যাডাম ছিলেন ভূগোলের শিক্ষক। তাই এসএসসির রেজাল্টের পর আর ম্যাডামের ক্লাস পাইনি। কিন্তু যখনই দেখা হতো, কেমন আছি জিজ্ঞেস করতেন। গ্রীষ্মকালে আমাদের রাতে খাবারের আগে পরে নিজস্ব পড়াশোনার সেশনের (আমরা বলতাম প্রেপ) সঙ্গে সঙ্গে বিকেলেও একটা প্রেপ হতো খেলতে যাওয়ার আগে। আফটারনুন প্রেপ ছিল ক্যাডেট জীবনের এক বিভীষিকা। দুপুরের খাবারের পর একটু বিশ্রামের সময় যখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসত, তখনই আফটারনুন প্রেপের ঘণ্টা বাজতো। কাঁচা ঘুম ভেঙে কলেজ অথোরিটিকে গালাগালি করতে করতে আমরা একাডেমি ব্লকের দিকে ছুটতাম। আফটারনুন প্রেপে বসে কখনো ঘুমায়নি এমন ক্যাডেট বিরল। তো ক্লাস টুয়েলভে পড়ার সময় একদিন আফটারনুন প্রেপে নাজনীন ম্যাডাম এসেছেন গার্ড হিসেবে। ম্যাডাম সাধারণত ক্লাসে ঢুকে ডায়াসে দাঁড়ায়ে অথবা কোনো খালি ডেস্ক থাকলে সেখানে বসে বই অথবা পত্রিকা পড়তেন। আমরা ঘুমালেও তেমন কিছু বলতেন না। বড়জোর স্নেহভরে ডেকে উঠিয়ে দিতেন। সেদিন আমরা ম্যাডামকে সরাসরি বললাম, ‘ম্যাডাম, একটু ঘুমাই?’ ম্যাডাম একটু নকল রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘ইশ্‌, মামাবাড়ির আবদার।’ আমরা হার না মেনে বললাম, ‘ম্যাডাম আজ অনেক টায়ার্ড। প্লিজ ম্যাডাম।’ ম্যাডাম এইবার নিজের বইয়ের দিকে তাকিয়েই বললেন, ‘যা খুশি করো। আমি কিছু জানি না।’ এইবার আমরা আমাদের আসল কথা পাড়লাম, ‘ম্যাডাম প্রিন্সিপাল স্যার চলে আসতে পারেন। আপনি একটু বারান্দায় দাঁড়ায়ে দেখবেন?’ আমাদের কথা শুনে ম্যাডাম কিছুক্ষণ হতবাক হওয়ার ভান করলেন। কিন্তু ঠিকই বারান্দায় গিয়ে পিলারে হেলান দিয়ে পড়া শুরু করলেন। আর আমরা নিশ্চিন্তে ঘুম! ক্যাডেট কলেজের মতো একটা জায়গায় এমন স্নেহশীলতা দেখানো শুধু নাজনীন ম্যাডামের পক্ষেই সম্ভব ছিল। ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হওয়ার পরেও যে কলেজেই তাঁর পোস্টিং হোক না কেন, আমাদের খবর ঠিক রাখতেন। কখনো দেখা হলেই সেই একই স্নেহ আর আন্তরিকতার সঙ্গে গল্প করতেন। কয়েক বছর আগে হঠাৎ ম্যাডাম চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সে খবরে অনেকেই আমরা কেঁদেছি। এখনো কলেজের অনেক শিক্ষক ফোন করেন। পত্রিকায় আমার কোনো ছবি দেখলে কিংবা খবর পড়লে অনেক খুশি হন। কিছুদিন আগে হালিমা ম্যাডাম ফোন করলেন। হালিমা ম্যাডাম ও রওশন স্যার দুজনই আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। রওশন স্যার কিছুদিন আগে অবসরে গেছেন। হালিমা ম্যাডাম এখন ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজের প্রিন্সিপাল। তাঁরা একটা হোম লোন নেওয়ার জন্য আইপিডিসির তরুণ রিলেশনশিপ ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাঁরা বারবার আমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য রিলেশনশিপ ম্যানেজারকে বললেও তিনি একটু দ্বিধা করছিলেন। শেষে তিনি ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারকে ফোন করে কী করবেন জানতে চাইলেন। ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার তাঁকে বললেন, ‘ভাইয়ার টিচার যদি ফোনে কথা বলতে চান, অবশ্যই ফোনে কানেক্ট করে দাও।’ ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে ঘটনা জানালেন। কিছুক্ষণ পরে রিলেশনশিপ ম্যানেজার আমার মোবাইলে ফোন করে ভয়ে ভয়ে বলছেন, ‘স্যার, আপনার ক্যাডেট কলেজের টিচার হালিমা ম্যাডাম আমাদের থেকে একটা হোম লোন নেবেন। আমি তাঁকে সবকিছু বুঝিয়ে বলেছি। কিন্তু উনি তারপরও আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন।’ আর ওই দিকে ম্যাডাম বলছেন, ‘আরে তুমি ফোনটা আমার কাছে দাও না। আমি আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলব।’ আমি বললাম, ‘ম্যাডামকে ফোন দাও।’ ম্যাডাম ফোন হাতে নিয়েই বললেন, ‘বাবা মমিন, কেমন আছ?’ ঠিক যেন আমার মায়ের কণ্ঠস্বর!

আমাদের শৈশব আর কৈশোরের প্রিয় শিক্ষকেরা এক এক করে চলে যাচ্ছেন না ফেরার দেশে। অনেকেই আছেন আর্থিক কিংবা শারীরিক দুরবস্থার মধ্যে। আদর-ভালোবাসা আর শাসনে শিক্ষকেরা মসৃণ করেছেন আমাদের অর্জনের পথচলা। কিন্তু আজ কেমন আছেন তাঁরা? আমরা কী রেখেছি তাঁদের খোঁজ? এখন সময় এসেছে সেই শিকড়ে ফেরার!

শিক্ষকদের সম্মান জানাতে শুরু হয়েছে ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা ২০১৯’। আপনার শৈশবের প্রিয় শিক্ষককে মনোনীত করতে লগইন করুন-https://www. ipdcbd. com/priyoshikkhok

লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও