জীবন থেকে শেখা

টেলর সুইফট
টেলর সুইফট
>আগামী ডিসেম্বরে পপ তারকা টেলর সুইফটের বয়স হবে ৩০। এই বয়সেই সুইফট পেয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ‘এন্টারটেইনার’-এর তকমা। ফোর্বস আর টাইম সাময়িকীর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় একাধিকবার এসেছে তাঁর নাম। জীবনের ৩০তম বছর শুরুর আগে গত মার্চ মাসে টেলর সুইফট এল ম্যাগাজিনে একটি কলাম লেখেন, তুলে ধরেন জীবনে পাওয়া ৩০টি শিক্ষার কথা। সেখান থেকে নির্বাচিত ১০টি থাকছে এই লেখায়।

জন্মসনদ অনুযায়ী, এ বছর আমার বয়স ৩০ হবে। মজার ব্যাপার হলো, এখন আমার মাঝেমধ্যে নিজেকে ১৮ বছরের কিশোরী মনে হয়, কখনো আবার নিজের বয়স মনে হয় ২৮৩ বছর। কিন্তু আদতে আমার বয়স ২৯। শুনেছি মানুষ বলে, ৩০-এর পরেই নাকি শুরু হয় জীবনের আসল মজা! সেটা নাহয় সময় এলেই দেখা যাবে। এর আগে বরং আমি ৩০–এর আগে জীবনের কাছ থেকে পাওয়া কিছু শিক্ষা আপনাদের জানাই।

আমি উটকো উৎপাত বন্ধ করতে শিখেছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটা দারুণ ব্যাপার। কিন্তু এটা মাঝেমধ্যে নিজের ভেতর এমন কিছু শূন্যতার সৃষ্টি করে, যা প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করায়—আমার কী নেই, আমি কতটা ব্যর্থ অথবা আমার আশপাশে সবাই আমার চেয়েও সেরা। একটা বিশেষ উপায়ে এই অনিশ্চয়তায় ভরা পরিস্থিতি থেকে আমি নিজেকে দূরে রেখেছি। আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘কমেন্ট’ (মন্তব্য) পড়া বন্ধ করে দিয়েছি। হ্যাঁ, আমার কোনো পোস্টের নিচের কমেন্টই আমি পড়ি না। ভক্ত আর পরিচিতজনদের আমার নিত্যদিনের খোঁজখবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঠিকই দিই। কিন্তু আমি মানসিকভাবে নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করেছি যে কারও মন্তব্য বা মতামতের জন্য আমার জীবন থেমে থাকবে না। আমার মনে হয় ইন্টারনেট-নির্ভর প্রশংসার ওপর নির্ভরশীল কম হওয়া আত্মসম্মান ধরে রাখার জন্য খুব ভালো।

বারবার চেষ্টা করা আর ব্যর্থ হওয়া স্বাভাবিক। আমার জন্য অবশ্য চড়াই-উতরাই সব সময় স্বাভাবিক ছিল না। কারণ, আমার প্রতিটি সাফল্য আর ব্যর্থতাকে ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো প্রচণ্ড বাড়িয়ে-চড়িয়ে তুলে ধরত। এটাই আমাকে শিখিয়েছে, মাঝেমধ্যে সব ওলটপালট হয়ে গেলেও তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আবার ঝুঁকি নেওয়া খুব ভালো ব্যাপার। বিশেষ করে, ৩০–এর আগেই এই ঝুঁকিগুলো নেওয়া যায়; কারণ এ সময়েই সবাই একটা অন্বেষণের মধ্যে থাকে। না, আমি বলছি না এখন তোমাকে তোমার সাবেক প্রেমিক–প্রেমিকার কাছে আবার ফিরে গিয়ে নতুন করে ঝুঁকি নিতে। অবশ্য তুমি যদি এই মুহূর্তে মনে করো, প্রাক্তনের কাছে ফিরে যাওয়াটাই তোমার লক্ষ্য, এর অন্বেষণই তুমি করছ, তাহলে যেতেও পারো। হয়তো আবার হোঁচট খেয়ে এখান থেকে শিখবে কিছু।

আমি এখন আর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে অন্যের মূল্যায়নের প্রভাব পড়তে দিই না। অনেক লম্বা সময় পর্যন্ত অপরিচিত ব্যক্তিদের মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে নিজের সম্পর্ককে মেপেছি। আমাকে কার সঙ্গে ভালো দেখায়—এ নিয়ে ইন্টারনেটে হওয়া জরিপের ফলাফলও একটা সময় আমার সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলত, ইনস্টাগ্রামে দেওয়া ছবির নিচে আসা মন্তব্য আমাকে বদলে দিত। কিন্তু এসব আসলে অর্থহীন। আমার মতো স্বীকৃতি-পাগল মানুষের জন্য এটা একটা বড় শিক্ষা—জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো বোঝার জন্য নিজস্ব মূল্যায়নপদ্ধতি থাকা দরকার।

কাছের মানুষদের কষ্ট দেওয়ার পর তাঁদের কাছে ক্ষমা চাইলে তুমি ছোট হয়ে যাবে না। হয়তো তুমি ইচ্ছা করে তাঁদের কষ্ট দাওনি। এরপরও। ক্ষমা চাইলে সব সহজ হয়ে যায়। ‘আমি দুঃখিত, কিন্তু.... ’ এভাবে আবার নিজেকে জাহির বা সমর্থন করে ক্ষমা চাইতে যেয়ো না। মন থেকে নিজেকে সমর্পণ করতে শেখো। দেখবে, বন্ধুত্বে ও সম্পর্কে বিশ্বাসের চিড় আর ধরবে না।

যখন খুব আপন কেউ এমন কোনো সংকটে পড়ে, যার মধ্য দিয়ে তুমি কোনো দিন যাওনি; তখন ওই আপনজনকে সান্ত্বনা দেওয়া একটু কঠিন লাগতে পারে। তখন তুমি বলে দাও যে তুমি সত্যিই জানো না এই পরিস্থিতিতে কী বলতে হয়। মাঝেমধ্যে কঠিন সময়ে তাঁরা উপদেশ নয়, তোমার পাশে থাকার স্বস্তিটুকুই অনুভব করতে চায়। সবার কাছে সব পরিস্থিতির সমাধান থাকে না। তাই বলে কাছের মানুষের প্রয়োজনের সময় তাঁদের অন্ধকারে ফেলে চলে যাওয়া যাবে না। কঠিন সময়ে প্রিয় মানুষের কাছে থাকাটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। সেই মানুষটা কিছু করুক বা না করুক।

টেলর সুইফট
টেলর সুইফট

চিরকালের বন্ধুত্ব আর পরিস্থিতির কারণে বন্ধুত্বের মধ্যে তফাৎ করতে শিখেছি আমি। ২০-এ পা রাখলে মানুষ বন্ধুত্বকে অনেক গভীরভাবে নেওয়া শুরু করে। যে দলের সঙ্গে সে মেশে, মনে হয়ে সেটাই হয়ে গেছে তাঁর পরিবার। কারও কারও ক্ষেত্রে সেই বন্ধুত্ব টিকেও যায়। কিন্তু অনেকের বেলায় আবার ওই বন্ধুত্বটা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই হয়। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে সেই বন্ধুদের পাওয়া যায়, পাওয়া যায় অমূল্য অনেক স্মৃতি। সে বন্ধুত্বের অর্জন ওইটুকুই। বিষয়টা দুঃখের, তবে বাস্তবতা হলো আমরা বড় হই, কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিছু কিছু বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক আর বাড়ে না। আমরা এগিয়ে যাই, সেই বন্ধুত্ব পড়ে যায় পেছনে। আমরা শুধু স্মৃতিগুলো নিয়ে সামনে চলে আসি।

পরিবারে কারও কঠিন রোগ হলে কীভাবে সব সামলে নিতে হয়, এত দিনে এসে শিখেছি। আমার মা-বাবা দুজনেরই ক্যানসার ছিল। মা এখনো ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছেন। এই লড়াই আমাকে শিখিয়েছে জীবনের কঠিন থেকেও কঠিনতম সময়ে নিজেকে শক্ত রাখতে। মায়ের ক্যানসারের চিকিৎসার সময় আমি এত বেশি দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতাম আর ভেঙে পড়তাম যে আমার মনে হতো, এর চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। এই দুশ্চিন্তার সামনে পৃথিবীর আর সব দুঃখ-কষ্ট ম্লান লাগে এখন।

‘তুমি যদি সুখে থাকতে শুরু করো, তাহলে গান লিখবে কীভাবে?’—অনেকেই আমাকে এই প্রশ্ন করে। শিল্প সৃষ্টির জন্য নাকি শিল্পীকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা আর কষ্টের মধ্যে থাকতে হয়। এমনটা অনেকের ধারণা। দুঃখ আর শিল্প নাকি হাত ধরাধরি করে চলে। আমি খুব সৌভাগ্যবান। কারণ, আমি জেনে গেছি, এই ধারণা ভুল। সুখ আর অনুপ্রেরণা একসঙ্গে খুঁজে পাওয়া দারুণ ব্যাপার।

যখনই আমি বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে যাই, তখনই আমি ‘কাউন্টডাউন অ্যাপ’ খুলে বসি। সেই অ্যাপে একটা সময় সেট করে দিই। যা করতে আমি ভালোবাসি, নির্দিষ্ট সময় পর সেটা করব—এমনভাবে কাউন্টডাউন চালু করে দিই। ফলে বাজে সময়েও আমি অদ্ভুত স্বস্তি পাই। খুব বড় কিছু নয়, সেটা হতে পারে ছুটির দিন শুরু হওয়ার কাউন্টডাউন কিংবা নতুন গান মুক্তির কাউন্টডাউন। সামনের দিকে তাকিয়ে ভালো কিছুর অপেক্ষা করায় স্বস্তি আছে।

১০

আমার মা আমাকে বলেন, ছোটবেলায় নাকি আমাকে তিনি কোনো শাস্তি দিতেন না। কারণ, ছোট ছোট ভুলের জন্য আমি নাকি নিজেই নিজেকে শাস্তি দিতাম। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার শাস্তি হিসেবে আমি নিজেই নিজেকে ঘরে বন্দী করে ফেলতাম। আমার মনে হয়, আমি এখনো তেমনটা করি। ছোট ছোট ভুলের জন্য নিজেকে শাস্তি দিই, বন্দী করে রাখি, নিজেকে আটকে ফেলি। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। তবে এখন আমি বুঝতে শিখেছি, ভুল সিদ্ধান্তের জন্য, ভুল মানুষকে বিশ্বাস করার জন্য, সবার সামনে হোঁচট খাওয়ার জন্য নিজেকে দোষী ভাবা যাবে না। নিজেকে ক্ষমা করে দিতে হবে। সব ভুলে আলোর দিকে যেতে হবে।

আদর রহমান, এল ম্যাগাজিন অবলম্বনে