কাছ থেকে দেখা

গ্রেটা থুনবার্গের সঙ্গে লেখক
গ্রেটা থুনবার্গের সঙ্গে লেখক
গ্রেটা থুনবার্গ। ১৬ বছর বয়সী সুইডিশ পরিবেশকর্মী। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জাতিসংঘের ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটে বক্তব্য দিয়ে রীতিমতো আলোচিত সে। টাইম ম্যাগাজিন গত মে মাসের প্রচ্ছদেই তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নেতা’ হিসেবে। জাতিসংঘের তরুণ জলবায়ু সম্মেলনে গ্রেটার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বাংলাদেশের তরুণ সংগঠক তাহসীন উদ্দিনের। সেই অভিজ্ঞতা লিখেছেন তাহসীন। সঙ্গে থাকছে গ্রেটার গল্প ও আলোচিত সেই বক্তব্যের ভাষান্তর।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ইউনিসেফ সদর দপ্তরের লবিতে বসে গল্প করছিলাম। সঙ্গী যে তিনজন, তাঁরা আমার মতোই বিভিন্ন দেশ থেকে আসা তরুণ। নিজেদের মধ্যে গল্পটা তখন জমে উঠেছে। আলাপের বিষয়বস্তু সম্মেলন আর জলবায়ু থেকে সরে ব্যক্তিগত বিষয়ে চলে এসেছে। আমার দেওয়া একটা উপহার নিয়ে খুনসুটিও শুরু হয়েছে।

ঠিক তখনই খেয়াল করলাম, ধীর পায়ে ছিপছিপে গড়নের এক মেয়ে হেঁটে আসছে। তাকে ঘিরে এগিয়ে আসছেন কয়েকজন। এতক্ষণ সেই পথে আরও অনেকেই হেঁটে এসেছে। কিন্তু চকিত দেখে দৃষ্টি আটকে যাওয়ার কারণ, সেই মেয়েটা গ্রেটা।

গ্রেটা থুনবার্গ। গত ২২ সেপ্টেম্বরের সেই বিকেল পর্যন্ত সুইডিশ এই কিশোরীর কথা নির্দিষ্ট একটা গণ্ডিতেই ছিল। কারণ, পরদিনই ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিট-২০১৯’ নামে বিশ্বনেতাদের সম্মেলনে সেই আলোচিত বক্তৃতা করে গ্রেটা। তবে জলবায়ু আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম কিংবা এ বিষয়ে কিছুটা খবর রাখেন, তাঁদের কাছে গ্রেটা পরিচিত নাম আগে থেকেই। জলবায়ু নিয়ে তার উচ্চকিত ভূমিকার জন্যই তো তরুণ নেতা হিসেবে উঠে এসেছিল বিখ্যাত টাইম সাময়িকী প্রচ্ছদে।

গ্রেটার সঙ্গে কথা বলার আগ্রহটা তাই যেকোনো জলবায়ুযোদ্ধার কাছে আকাঙ্ক্ষিত। ততক্ষণে গ্রেটা প্রায় চলে এসেছে। তাকে দৃপ্ত পায়ে হাঁটতে দেখে মনে হচ্ছিল, কোনো বোদ্ধা হেঁটে আসছে। অথচ মেয়েটির বয়স সবে ১৬। কাছে আসতেই আমরা চারজন এগিয়ে গেলাম। আগ বাড়িয়ে আমিই বললাম, ‘এই যে গ্রেটা, কেমন আছ?’

মৃদু হাসি, সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘বেশ ভালো।’

এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা ফেলেছিল। তখন আবারও ইংরেজিতে বললাম, ‘নানা সময়ে বক্তৃতায় আর কাজে তুমি তো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছ, তোমাকে অভিনন্দন।’ বিনয়ের সঙ্গে মাথা ঝাঁকাল। আবারও বললাম, ‘আমাদের জন্য তোমার কোনো বিশেষ বার্তা আছে?’ গ্রেটা বলে গেল সেই বক্তৃতার মতো করেই, ‘এখনো বিশ্বের অনেক মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি সম্পর্কে অবগত নয়, তাদের সজাগ করতে হবে। সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কাজটা আমাদেরই করতে হবে।’

আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু সঙ্গে থাকা লোকজন জানাল, এখনই গ্রেটাকে যেতে হবে, তার একটা সেমিনারে উপস্থিত হওয়ার সময় হয়ে এসেছে। অগত্যা আর কথা না বাড়িয়ে ছবি তোলার কথা জানালাম। গ্রেটা হাসিমুখে এগিয়ে এল। কিন্তু ছবি তোলার সময় খেয়াল করলাম, তার সেই চিরাচরিত গম্ভীর মুখ!

 ছবি তোলা শেষে যখন আমাদের ‘বিদায়’ বলছিল, তখন আরও একটি শব্দটি উচ্চারণ করল. ‘সরি’। এটা বলার কারণ, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমাদের সঙ্গে সময় নিয়ে কথা বলতে পারছে না, তাই।

আগের দিনই ছিল ইয়ুথ ক্লাইমেট সামিট বা তরুণ জলবায়ু সম্মেলন। ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণ জলবায়ু অ্যাকটিভিস্টদের সেই সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বেও গ্রেটার দেখা পেয়েছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বিশ্বের ১৪০টি দেশের ৫ শতাধিক তরুণের সঙ্গে আমিও অবাক হয়ে শুনছিলাম গ্রেটা থুনবার্গের স্পষ্ট বার্তা। সে বলেছিল, ‘আমরা বাস্তবিক অর্থে ক্লাইমেট অ্যাকশন দেখতে চাই। আজ ২১ সেপ্টেম্বরে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু ধর্মঘটে আমরা লাখো তরুণকে দেখিয়েছি যে আমরা এই বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ এবং অপ্রতিরোধ্য।’

উদ্বোধনী সেই বক্তব্য ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। তখনই সে বলছিল, বিশ্বনেতাদের নিয়ে যে সম্মেলন হবে, সেখানে বক্তব্য দেবে গ্রেটা। এখন তো সেই আলোচিত বক্তব্য অনেকেরই শোনা।

সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা তরুণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে লেখক
সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা তরুণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে লেখক

গ্রেটা ছাড়াও সেই উদ্বোধনী পর্বে বক্তব্য শুনেছি ব্রুনো রদ্রিগেজ, ওয়ানজুহি জর্জ ও কামাল কারিশমার। তাঁরা সবাই তরুণ জলবায়ুযোদ্ধা। তাঁদের সঙ্গে ‘কি নোট লিসেনার’ হিসেবে ছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গুতেরেসের একটা কথা খুবই ভালো লেগেছিল, তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বনেতারা শুধু প্রধান বক্তা হতে চান, শুনতে চান কম। কিন্তু আমাদের তরুণদের কথাগুলো বেশি করে শোনা উচিত।’

গ্রেটার সঙ্গে সেই চকিত সাক্ষাতের মতো জাতিসংঘের আয়োজনটায় আরও বেশ কিছু মনে রাখার মতো ঘটনা ঘটেছে। যেমন সেই আয়োজনে বাংলাদেশের হয়ে অংশ নিতে পারাও নিঃসন্দেহে অনেক বড় সুযোগ। যে সুযোগ আমাকে করে দিয়েছিল ইউনিসেফ বাংলাদেশ। শুধু সুন্দর সুন্দর আলোচনা আর বক্তব্যেই নয়, তরুণেরা তুলে ধরেছিলেন তাঁদের উদ্ভাবনী কার্যক্রমগুলোও। এর মধ্যে ছিল প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে থ্রিডি প্রিন্টিং, কৃষকদের জন্য আবহাওয়ার অ্যাপ, কৃষি তথ্যভান্ডার ইত্যাদি।

বিশেষভাবে মনে থাকবে ২১ সেপ্টেম্বরের বিশ্ব জলবায়ু ধর্মঘটে অংশ নেওয়ার কথা। সেদিন সকালেই প্ল্যাকার্ড বানাতে জড়ো হয়েছিলাম ইউনিসেফ সদর দপ্তরে। প্ল্যাকার্ড বানাতে বানাতে সখ্য হয়ে গিয়েছিল বিভিন্ন দেশের তরুণদের সঙ্গে। দুপুরে নিউইয়র্কের রাজপথে নেমে মানুষ অবাক হয়ে দেখেছে, হাজার হাজার শিক্ষার্থী জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে স্লোগান দিচ্ছে। সবার হাতেই নিজের বানানো প্ল্যাকার্ড। সঙ্গে যুক্ত হলেন বয়স্ক মানুষও। রাস্তায় জায়গা না পেয়ে অনেক ভবনের কাচের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকল প্ল্যাকার্ড নিয়ে। ভেবে খারাপ লাগল জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা আমার দেশের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই এখনো জানেন না এ বিষয়ে।

এমন আরও নানা আয়োজন আর ঘোরাঘুরিতে কেটেছে সম্মেলনের কটা দিন। ২৯ সেপ্টেম্বর যখন দেশের পথে নিউইয়র্ক ছাড়ি, তখনই মনে হচ্ছিল, নতুন উদ্যমে কাজ করার এখনই সময়। সেই সঙ্গে ঘুরেফিরে আসছিল গ্রেটা থুনবার্গের মুখ।

কারণ, ফেসবুকজুড়ে শুধু তারই বক্তৃতার ভিডিও দেখছিলাম। মনে মনে গর্বই হচ্ছিল, নবীন এই জলবায়ু অ্যাকটিভিস্টের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে ভেবে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, লাল–সবুজ সোসাইটি, বরিশাল