শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা যিনি

মো. আসাদুল কবির
মো. আসাদুল কবির

শৈশবের দিনগুলো কেটেছে অন্যের বাড়িতে কাজ করে। সেই কঠিন সময়ে তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা। বয়স যখন ৮, নিজ উদ্যোগেই ভর্তি হন স্থানীয় বিদ্যালয়ে।

তিনি মো. আসাদুল কবির। এখন হাজারো শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণা, প্রিয় শিক্ষক। ১৯৬৫ সালের পয়লা মার্চে তাঁর জন্ম পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানি উপজেলায়। বাবা ছিলেন দিনমজুর। অভাবের সংসারে কাজ করতেন প্রতিবেশীর বাড়িতে। কাজের পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর লেখাপড়া। ১৯৭৯ সালে স্থানীয় বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন খুলনার বিএল কলেজে। তখন পড়াশোনার খরচ চালাতে খুলনার দৌলতপুর অটোরিকশা সমবায় সমিতিতে হিসাবরক্ষক হিসেবে চাকরি নেন। পাশাপাশি করতেন টিউশনি।

‘তবে শেষ পর্যন্ত খুলনা থেকে আর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া হয়নি আমার।’ বলেন আসাদুল কবির। এক শিক্ষকের সহায়তায় তিনি ফিরে যান পিরোজপুর। সেখানে ভান্ডারিয়া কলেজ থেকে অংশ নেন এইচএসসি পরীক্ষায়। তাঁর স্কুলশিক্ষক এ বি এম সাইদুর রহমান তখন মোরেলগঞ্জের পাঁচগাঁও এমএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। একদিন আসাদুল কবিরকে ডেকে নিয়ে বলেন, ‘পড়াশোনা চালাতে গেলে তো একটা কিছু করা দরকার। আমার এখানে শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক হও।’ এইচএসসিতে উত্তীর্ণ হয়ে সেখানে ১৯৮১ সালে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন আসাদুল।

চাকরির প্রয়োজনেই যুক্ত হন স্কাউটিংয়ে। স্কাউটিংয়ের সময় আয়ত্ত করেছেন আনন্দের মাধ্যমে পাঠদানের কৌশল। এসবই কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ও খেলাধুলায় দারুণ অনুপ্রাণিত করেন তিনি। পাশাপাশি চলিয়ে গেছেন পড়াশোনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি হয়ে ১৯৮৭ সালে স্নাতক পাস করেন। ১৯৮৯-৯০ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অব ফিজিক্যাল এডুকেশন (বিপিএড) সম্পন্ন করেন।

কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ স্কাউটসের উড ব্যাজ এবং ২০০০ সালে এএলটি পদ লাভ করেন। শ্রেষ্ঠ স্কাউট শিক্ষক হিসেবে তিনি বেশ কয়েকবার উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে পদক পেয়েছেন।

বিদ্যালয়ের দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে তাদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতেও সচেষ্ট আসাদুল কবির। অভিভাবকদের সম্মতিতে শিক্ষার্থীদের ছোট পরিসরে হাঁস-মুরগি পালন, বাড়ির পরিত্যক্ত জমিতে সবজি চাষ, অবসরে খাল-বিলে মাছ শিকার করার মতো কাজেও উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। পাঁচগাঁও এমএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন প্রায় ১৯ বছর। প্রত্যন্ত ওই জনপদে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও খেলাধুলার প্রতি দারুণভাবে আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সবাই স্মরণ করে। ১৯৯৮ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন বাগেরহাট সদরের বেমরতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ২০০৪ সালে প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী কাড়াপাড়া শরৎচন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও শতবর্ষী বিদ্যালয়টিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন তিনি।

 আসাদুল কবির বলছিলেন, ‘আমার কোনো ব্যক্তিগত জমি বা সম্পত্তি নেই। ছাত্রছাত্রীরা খোঁজ নেয়, এটাই আমার পরম পাওয়া। এই যে আইপিডিসি–প্রথম আলো সম্মাননা পেলাম, এর মনোনয়ন তো দিয়েছিল আমার কোনো শিক্ষার্থী।’