বাধাজয়ী শিক্ষক

আবুল হাশেম মিয়া
আবুল হাশেম মিয়া

আবুল হাশেম মিয়া শ্রবণপ্রতিবন্ধী। তাতে তিনি দমে থাকেননি। জয় করে নিয়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থীর হৃদয়। প্রমাণ করেছেন, কর্মনিষ্ঠা আর অধ্যবসায় থাকলে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা জয় করা যায়।

আবুল হাশেম মিয়া টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার আউলিয়াবাদ মাজার দাখিল মাদ্রাসার শরীরচর্চা শিক্ষক। ১৯৯৯ সাল থেকে এই মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষকতা করছেন। কেবল শরীরচর্চার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ছাত্রছাত্রীদের অন্যান্য বিষয়ও পড়ান। শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে নিজের সন্তানের মতো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের পড়াশোনার খবর নেন। প্রতিষ্ঠানের চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ মেরামতসহ যেকোনো কাজ করেন নিজ হাতে। কোনো কাজেই কারও মুখাপেক্ষী হন না। যেকোনো কাজ নিজ হাতে করার মধ্য দিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের শেখাতে চান, কোনো কাজ ছোট নয়।

আবুল হাশেম মিয়ার জন্ম ১৯৭৭ সালে, টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কালিয়া ঘোনারচালা গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি প্রচণ্ড ঝোঁক ছিল। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হন। তারপর থেকে একেবারেই কানে শুনতে পান না। তিনি জানান, শ্রবণপ্রতিবন্ধী হওয়ার পর স্কুলে গেলে কোনো কথা শুনতে পেতেন না। শিক্ষকেরা কী পড়াচ্ছেন, তা বুঝতে কষ্ট হতো। সে সময় তাঁর বাবা লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু কিছুতেই হাশেম মিয়া লেখাপড়া ছাড়তে রাজি হননি। বাবা-মাকে জানিয়ে দেন, লেখাপড়া তিনি করবেনই। অবশেষে বাবা-মা তাঁদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। ১৯৯১ সালে সখীপুরের ঘোনারচালা হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন আবুল হাশেম। পরে একই উপজেলার মুজিব কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

কীভাবে এত জনপ্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠলেন তিনি—জানতে চাইলে আবুল হাশেমের স্ত্রী, একই মাদ্রাসার শিক্ষক রহিমা খাতুন বললেন অনেক কথা। বিয়ের পর রহিমা খাতুনের প্রথম চাকরি হয় আউলিয়াবাদ মাজার দাখিল মাদ্রাসায়। স্ত্রীর সঙ্গে মাঝেমধ্যে মাদ্রাসায় যেতেন আবুল হাশেম। কখনো কোনো শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে তাঁদের হয়ে ক্লাস নিতেন। তখনই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের নজর কাড়েন তিনি। পরে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি আবুল হাশেমকে শরীরচর্চা শিক্ষকের শূন্য পদে নিয়োগ দেয়। অবশ্য সে সময় অনেকে বিরোধিতাও করেছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কীভাবে শিক্ষকতা করবেন। কিন্তু অল্প দিনেই সে ধারণা ভেঙে দেন আবুল হাশেম। সব শিক্ষার্থী ও সহকর্মীর মন জয় করে নেন।

আবুল হাশেম মিয়া এখন সপরিবার বাস করেন মাদ্রাসার কাছেই আউলিয়াবাদ গ্রামে। সেখানে সবাই তাঁকে একনামেই চেনে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা জানায়, আবুল হাশেম স্যার সবাইকে খুব ভালোবাসেন। শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ালেখার খবর নেন। কেউ দু–এক দিন মাদ্রাসায় না এলে খোঁজ নিতে ছুটে যান বাড়িতে।

আবুল হাশেমের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং মেয়ে ময়মনসিংহ নার্সিং কলেজে বিএসসি নার্সিং বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। আবুল হাশেমের প্রাক্তন ছাত্র আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘হাশেম স্যার তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে মাদ্রাসার এবং গ্রামের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর সততা, একাগ্রতা তাঁকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।’