আসল কাজ মানুষ গড়া

>

মডেল: নয়ন, ছবি: খালেদ সরকার
মডেল: নয়ন, ছবি: খালেদ সরকার

কথাটা এখন অনেকের মনেই চিন্তার খোরাক জোগাচ্ছে—শুরুতে বিদ্যা অর্জনের জন্য আমরা ছিলাম শিক্ষার্থী, এরপর হয়ে গেলাম পরীক্ষার্থী, আর এখন যেন শুধুই নম্বরার্থী! নম্বরের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমাদের পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বোধ হয় তাদের আসল কাজ, ‘মানুষ গড়া’ থেকে একটু দূরে সরে গেছে। যার ফল ভোগ করছে সমাজ। বিদ্যা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু মনুষ্যত্ব অর্জনের গুরুত্ব আমরা যেন ভুলে না যাই। লিখেছেন লেখক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন।

বুয়েটের ছাত্রমাত্রই তো উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থী হিসেবে ভালো রেকর্ডের অধিকারী। আর ভালো ছাত্ররা সাধারণদের তুলনায় বেশি সংবেদনশীল, মানবিক এবং নৈতিকতায়ও উন্নত হয়—এমনটাই তো মানুষ ভাবে। কিন্তু এই সাধারণ ধারণাটির ওপর আর আস্থা রাখা যাচ্ছে না। আবরার হত্যার পর এই আস্থায় চিড় যেন আরও বাড়ল। বুয়েটের ছাত্রী সনি হত্যার জন্য দায়ী ছাত্রটিও তো ছিল মেধাবী, পাবলিক পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলের অধিকারী। না, পরীক্ষার ভালো ফল ভালো মানুষের নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। সমাজে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতির মহামারি বিশ্লেষণ করলেও এর সত্যতাই মেলে।

শিক্ষার প্রধান দুই ক্ষেত্র পরিবার ও স্কুল শিশুর সুষ্ঠুভাবে মানুষ হয়ে ওঠার রসদ জোগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। পরিবার ও স্কুল শিক্ষার্থীর একাডেমিক সাফল্যের ওপর শতভাগ জোর দেওয়ায় তার একমাত্র কাজ হয়ে উঠেছে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বরের জন্য প্রাণপণে খাটা। এ প্রতিযোগিতার ফলে টেক্সট বই ছাপিয়ে নোটবই, শিক্ষকের চেয়ে টিউটর, স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টার এবং শিক্ষার চেয়ে পরীক্ষার গুরুত্ব বেড়ে গেছে। শিশু খেলার সময় পায় না, সৃজনশীল কাজের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়, সমবয়সীদের সঙ্গে দলে মিলে খেলার সুযোগ পায় না। গল্পের বই পড়া, নিছক মনের আনন্দে খেলে বেড়ানো, আপনমনে চুপচাপ সময় কাটানোর ফুরসত মেলে না। পরীক্ষার ফলাফলের প্রতিযোগিতায় বেড়ে উঠে তারা প্রতিযোগী হয়, সহযোগী নয়, তাতে মানবিক গুণাবলির বিকাশে ঘাটতি থেকে যায়। যুক্তি, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের জন্য যে ধৈর্য, প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতার প্রয়োজন, তা অধরাই থেকে যায়। তারা কেবল পক্ষ-বিপক্ষ, শত্রুমিত্রই বোঝে। অথচ মানুষের চরিত্র তো বহুমাত্রিক, জটিল, তার ভূমিকা ও চরিত্রের সরল ব্যাখ্যা বিপজ্জনক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। যে পোস্টের কারণে বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা ফাহাদকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল, তার মধ্যে সমালোচনামূলক বক্রোক্তি ছিল। এ থেকেই তাকে শত্রুপক্ষ গণ্য করে চরম ‘শিক্ষা’ দিয়েছে তারা। অথচ প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের ওপরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত-উচ্চারিত বিশেষজ্ঞ মতামতেও কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফাহাদের মতো আশঙ্কাই প্রকাশ পেয়েছে। তাতে বরং ফাহাদের মধ্যে পরিণত চিন্তার ছাপ মেলে। কিন্তু এখন এমন শিক্ষার্থীরাই অতি সক্রিয়, যারা জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত, দলীয় অন্ধ আনুগত্যের বশবর্তী হয়ে অ্যাকশনেই অভ্যস্ত। এদের পুরোধা হিসেবে ছাত্রলীগ যেন আজ একটি মস্ত বড় ট্র্যাজেডির খলনায়ক।

মানুষ গড়ায় ব্যর্থ
বহু মানুষের ত্যাগ ও স্বপ্নসাধের এই দেশে যখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেগবান হয়েছে, প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক সূচকে অগ্রগতি ঘটছে চমৎকারভাবে, তখন ক্রমেই মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে সংকট ও ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠছে। এটা রীতিমতো দুর্ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমাজে লোভ-ভোগবাসনা, হিংসা-বিদ্বেষ, সন্ত্রাস-নিষ্ঠুরতার প্রবল পরাক্রমের কাছে মনুষ্যত্ব ও বিবেক, চেতনা ও বোধশক্তি, মমতা ও সহানুভূতির প্রকাশ চাপা পড়ে যাচ্ছে।

তবে নিষ্ঠুরতার উপর্যুপরি আঘাতে মানুষের বোধশক্তি ভোঁতা হলেও বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের মতো কোনো কোনো ঘটনা সবার মনেই তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কেবল তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থরাই নয়, পথে নেমেছে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, এমনকি অনেক জায়গায় সাধারণ মানুষও প্রতিবাদ ও সংহতির সমাবেশে যোগ দিচ্ছে। চোখের সামনে এমন অন্যায়, একজন নিরপরাধ তরুণের এমন নিষ্ঠুর প্রাণহানি সহ্য করার মতো পাষাণ হয়নি এখনো মানুষের বিবেক।

এমন ঘটনার প্রেক্ষাপটে গতানুগতিক স্তোক বাক্য বেমানান। গৎবাঁধা গা-বাঁচানো যুক্তিও অচল। এটিকে কেবল কতিপয় বিপথগামীর বিচ্ছিন্ন অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কয়েকজনের জন্য পুরো সংগঠনকে দায়ী না করার ব্যাখ্যাও ধোপে টিকবে না। কারণ, তথ্য এবং বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে।

আধিপত্যের চক্র যায় না ভাঙা
২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন হিসেবে সব ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র দখলদারি চালিয়ে ছাত্রলীগ যে নিজের জন্যই মৃত্যুকূপ তৈরি করছে, সেটা কেউ খেয়াল করেনি। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এই ১০ বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৩৯ জন এবং তাদের হামলায় অন্য সংগঠন ও নির্দলীয় ১৫ জন তরুণ নিহত হয়েছে। এসব হানাহানির পেছনে কোনো আদর্শ কাজ করেনি, মূল কারণ বখরার ভাগাভাগি এবং ভিন্নমত। জানা যাচ্ছে, বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর রুমের মতো টর্চার সেল প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বা একাধিক রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের অবাধ্য হলে ওই নির্দিষ্ট কক্ষে শাস্তি ছিল অবধারিত। গালাগালি ও মারধর এবং নানাবিধ অপমান ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। এ পর্যন্ত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের এই আধিপত্যের চক্র ভাঙতে পারেনি। কারণটা অস্পষ্ট নয়। মূল রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ মাঠপর্যায়ের দখল বজায়ে এদের ওপর নির্ভর করে থাকেন। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষও তো আজকাল শতভাগ সরকারের মুখাপেক্ষী। সবমিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও তারুণ্যের সুষ্ঠু বিকাশের কোনো পরিবেশ আর নেই।
গুম হওয়ার পরে ফিরে আসা মানুষগুলো যেমন অভিজ্ঞতা বলেন না, গুম হয়েই থাকছেন, তেমনি টর্চার সেলে লাঞ্ছিত-নিপীড়িত শিক্ষার্থীরাও চেপে যায় তিক্ত অভিজ্ঞতা। ভয়ের সংস্কৃতি এভাবে মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বা প্রতিকারের ইচ্ছাটুকুও হরণ করে নেয়। গত ১০ বছরে সারা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের এমন অপরাধ এবং সেই সূত্রে অপরাধীর তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে। আবরার ফাহাদ আপাতত তাতে সর্বশেষ সংযোজন।

এই প্রতিবাদ নৃশংসতার বিরুদ্ধে। ছবিটি ৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় বুয়েট ক্যাম্পাসে তোলা। ছবি: আবদুস সালাম
এই প্রতিবাদ নৃশংসতার বিরুদ্ধে। ছবিটি ৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় বুয়েট ক্যাম্পাসে তোলা। ছবি: আবদুস সালাম

আস্থা হারিয়েছে ছাত্র সংগঠন
দুর্নীতির দায়ে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার অপসারণ ও যুবলীগে চলমান শুদ্ধি অভিযানে মানুষ কিছুটা আশান্বিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেত্রী এবং দলের সাধারণ সম্পাদক—উভয়েই দলীয় নেতৃত্বের কঠোর অবস্থানের কথাই বলছেন। মানুষ যেহেতু সব আশা-ভরসা হারিয়ে সর্বস্ব খুইয়ে টিকতে পারে না, তাই কোথাও একটু আশার খড়কুটো দেখতে পেলে তা আঁকড়ে ধরে ঘুরে দাঁড়াতে চায়। মানুষ প্রধানমন্ত্রীর শুদ্ধি অভিযানের ওপর ভরসা রাখতে চাইছে। কিন্তু এমন ঘটনা তা ভেস্তে দিতে চায়, দিতে পারে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই সময়ে সাধারণ ছাত্রদের চোখে ছাত্রলীগ ভিলেন, প্রতিপক্ষ। কারণ, অভিজ্ঞতা থেকেই তারা আবরার ফাহাদ হত্যাকে কতিপয়ের বিচ্ছিন্ন হঠকারিতা হিসেবে দেখবে না। আর বুয়েটের সাধারণ ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে তারা সব ছাত্রসংগঠনের ওপর আস্থা হারিয়েছে। সমাজের বৃহদংশের ধারণাও কিন্তু এ রকমই।

শিক্ষা পথ হারিয়ে বিপথগামী, রাজনীতি আদর্শ ও নীতিহীন হয়ে ক্ষমতার অন্ধ অনুসারী, সমাজ ক্ষমতাবানের দাপটে সন্ত্রস্ত হয়ে অপরাধের সঙ্গে সহবাসে অভ্যস্ত। এ অবস্থায় মূল্যবোধ ও নীতি, আইন ও নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ভিন্নমত ও সমালোচনা গ্রহণ করার শিক্ষা কোত্থেকে মিলবে?

কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কারণ শিশু, কিশোর, তরুণেরা দ্রুত শেখে, নতুন ভাবনা-চিন্তা-অভ্যাস রপ্ত করতে পারে সহজে এবং সবচেয়ে বড় কথা, তারা সব সময় মহৎ ভাবনা ও কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে উৎসুক। পদ্ধতি ও পরিবেশই তাদের সঠিকভাবে বড় হতে দিচ্ছে না।
আর রাজনীতি যদি জনতার স্বার্থ এবং নীতি-আদর্শ ছেড়ে ক্ষমতার চাকেই বাসা বাঁধে, তবে তা তারুণ্যের জন্য অভিশাপ হয়েই থাকবে।

আবার তোরা মানুষ হ
কবি-নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল বলেছিলেন, ‘গিয়াছে দেশ দুঃখ নাই/ আবার তোরা মানুষ হ।’ কবির কথার মর্মার্থ হলো দেশে খাঁটি মানুষের অভাব হয়েছে বলেই দেশ আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। তিনি পরাধীনতার প্রেক্ষাপটে এ কথা বলেছিলেন। তবে আমরাও তো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি মানুষের অধঃপতন ঘটলে দৃশ্যমান উন্নতির চাকচিক্যও দেশের অধঃপতন ঢাকতে পারে না। কারণ, দেশ তো আদতে মানুষেরই সমন্বয়। ব্রতচারী আন্দোলনের জনক গুরুসদয় দত্ত গান বেঁধেছিলেন, ‘মানুষ হ মানুষ হ আবার তোরা মানুষ হ।’ আসল কাজ মানুষের মতো মানুষ তৈরি নিশ্চিত করা। শিক্ষাকে মানুষ গড়ার উপযুক্ত করে ঢেলে সাজাতে হবে। রাজনীতিতে আদর্শ ও মূল্যবোধ, জাতি ও ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা চাই। রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন, স্বাধীনতার সংগ্রাম আদতে মনুষ্যত্ব অর্জনের সংগ্রাম।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক