ভালো থাকো গো মেয়ে...

চিকিৎসক কাজী নূর সিতান।  ছবি: সংগৃহীত
চিকিৎসক কাজী নূর সিতান। ছবি: সংগৃহীত

২০১৬ সাল। ঘটনার শুরু যেদিন, সেই সকালটাও ছিল অন্যান্য সকালের মতোই। ঘুম থেকে জেগে আড়মোড়া ভাঙতেই দেখি জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একটা সরু চকচকে সবুজ নারকেল পাতা উঁকি দিচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা আটটা প্রায় ছুঁই-ছুঁই, অফিসে দৌড়াতে হবে। আর ঠিক তখনই টের পেলাম বগলের নিচে বড় বড় দুটি চাকা। অফিসে এক জুনিয়র কলিগ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ম্যাডাম, কী হয়েছে, আপনাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’ আমি একটু ম্লান হেসে বললাম, ‘আমার ছোট্ট মেয়েটা বড্ড ছোট গো, এখনো আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারে না।’

 তারপর অনেক ইতিহাস। সুদীর্ঘ সময়ের আর্তনাদে জর্জরিত হয়ে আশা-নিরাশায় ভেসে ভেসে জীবনপাত! ভালোবাসার মানুষগুলোর সকরুণ মুখচ্ছবি, প্রিয় মুখগুলোর থেকে উচ্চারিত ভালোবাসা আর আশ্বাসের সুমধুর কথকতা, স্রষ্টার কাছে আনত হৃদয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা...। কেমোথেরাপি আর রেডিওথেরাপির সেই বিভীষিকাময় দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী! পাশের বাসার ছাদে টিনের ড্রামে লাগানো শেফালি ফুলগাছ থেকে টুপ করে ঝরে পড়ে একটা সফেদ শেফালি। গড়াগড়ি খায় সিমেন্ট বাঁধানো ছাদের ওপর। শিশিরে ভেজে না সে, হেমন্ত তখনো অনেক দূর!

সব ঋতু যায়, শরৎ, হেমন্ত, শীত... সব ঋতু। আমিও আবার হাসি, মনে মনে বলি আলহামদুলিল্লাহ... সকল প্রশংসা একমাত্র যে তোমারই! সাথী আপার মুখটা ভেসে ওঠে আমার ভাবনায়। কেমোথেরাপি দেওয়ার পর সব চুল পড়ে আবার যখন নতুন চুল গজাল, তখন সাথী আপাকে আরও বেশি শাবানা আজমির মতো দেখাত। মুখে হাসির সঙ্গে চোখ হাসত! সর্বশেষ সাথী আপার সঙ্গে দেখা হয়েছিল জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটে। হুইলচেয়ারে করে সাথী আপা আসতেন রেডিওথেরাপি নেওয়ার জন্য। আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতেন। এত অসুস্থতার মাঝে সবুজ ম্যাক্সির সঙ্গে ম্যাচ করে অনামিকায় জ্বলজ্বল করছে এক টুকরা সবুজ পান্না। আমি কথা বলতে বলতে মুখ ফিরিয়ে নিতাম, বিড়বিড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ বলতাম, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে।...’ এক ফোঁটা পানি টুপ করে আমার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ত, না সবুজ, না লাল... বড্ড রংহীন, ফ্যাকাশে, বিষাদময়! শেষ পর্যন্ত পারেননি সাথী আপা, পারেননি আরও অনেকেই।

কিন্তু আজ আমি না পারার কথা শোনাব না। আমাদের দেশে স্তন ক্যানসারের হার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ নিজের শরীরের প্রতি উদাসীনতা, কুসংস্কার, অহেতুক লোকলজ্জা ইত্যাদি। বেশির ভাগ সময়ই ক্যানসার যখন নির্ণয় হয়, তখন সেটির বিস্তার হয়ে পড়ে প্রায় অপ্রতিরোধ্য। অথচ বইপুস্তকের মাধ্যমে তো বটেই, ফেসবুক, ইউটিউব, অন্যান্য মাধ্যমেও আমরা স্তন ক্যানসারের লক্ষণগুলো জানতে পারি। বিশেষ পদ্ধতি শিখে নিজেরাই নিজেদের স্তন পরীক্ষা করতে পারি। আমাদের দেশে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা এখন বিশ্বমানের।

অক্টোবর মাসকে স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস হিসেবে পালন করা হয়। ক্যানসার সারভাইভর হিসেবে বলতে চাই, আমরা তো সর্বজয়া, কিন্তু একাকী নই। চলুন, এই মাসটিতে আমরা আমাদের চারপাশে কাজ করা, আমাদের অফিসের নারী অফিস সহকারী, বাসার ছোট বুয়া, সিঁড়ি ঝাড়ু দেওয়ার নারীকে ডেকে সহজভাবে দুটি কথা বলি। বলি, ‘ও মেয়ে, শোনো এই কথা... লজ্জার কিছু নেই, নেই কোনো সংকোচ, ভালোবাসো নিজেকে, এইটুকু চেষ্টা করো, একটু সচেতন হও, ভালো থাকো গো মেয়ে, ভালো রাখো তোমাকে ঘিরে থাকা প্রিয় মুখগুলোকে!’

চিকিৎসক কাজী নূর সিতান
সহকারী অধ্যাপক, ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলো ফেসিয়াল সার্জারি, ডেন্টাল ইউনিট
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ